সীমান্ত হত্যা নিয়ে বিএসএফ মহাপরিচালকের ব্যাখ্যায় দ্বিমত বিজিবি ডিজির
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ সদস্যদের প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার ও গুলি করে হত্যা প্রসঙ্গে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ মহাপরিচালক দালজিৎ সিং চৌধুরীর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী।
আজ বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৬তম সীমান্ত সম্মেলনের শেষ দিনে পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরে আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দুই মহাপরিচালক যার যার অবস্থান তুলে ধরেন।
সীমান্ত হত্যা ও প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে বিএসএফ মহাপরিচালক দাবি করেন, নিজ দেশের নিরাপত্তা ও হুমকি বিবেচনায় আত্মরক্ষার্থে প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
তবে বিএসএফ মহাপরিচালকের এ ব্যাখ্যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বিজিবি মহাপরিচালক।
সীমান্তে বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিকদের দ্বারা নিরীহ বাংলাদেশি নাগরিকদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা ও আহতের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সীমান্তে বিএসএফের প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়। ভুলবশত কেউ ভারতে অনুপ্রবেশ করলে তাদের আইন অনুযায়ী ফেরত পাঠাতে পারে বিএসএফ।
যদিও বিএসএফ মহাপরিচালক সীমান্তে অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রাতের বেলায় টহল জোরদার করে সীমান্ত হত্যার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সে ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
‘পুশব্যাক’ প্রসঙ্গে বিএসএফ মহাপরিচালক দালজিৎ সিং চৌধুরী দাবি করেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশকারীদের আইন অনুযায়ী ফেরত পাঠানো হচ্ছে। তিনি বলেন, অনুপ্রবেশকারীদের ক্ষেত্রে আইন ভঙ্গ করছে না ভারত।
বিএসএফ মহাপরিচালক ভারতে অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের পারস্পরিকভাবে সম্মত প্রক্রিয়া অনুযায়ী ফেরত পাঠানোর আশ্বাস দেন। বিজিবি মহাপরিচালক ফেনীর মুহুরীর চর এলাকায় স্থায়ী সীমান্ত পিলার নির্মাণ এবং ইছামতি, কালিন্দী, রায়মঙ্গল ও হাড়িয়াভাঙ্গা নদী এলাকায় সীমান্ত রেখা নির্ধারণের কাজ সম্পন্নের ব্যাপারে জোর তাগিদ দেন। বিএসএফ মহাপরিচালক এ বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সংস্থার কাছে উপস্থাপন করে তা সমাধানের আশ্বাস দেন।
সম্মেলনে সীমান্তে আক্রমণ, নির্যাতন ও হামলার ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনাসহ ১০ বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হয়েছে। সীমান্ত দিয়ে মাদক, অস্ত্র-গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক দ্রব্য, স্বর্ণ, জাল নোট এবং অন্যান্য চোরাচালান প্রতিরোধে সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার গুরুত্ব তুলে ধরে উভয় পক্ষ পাচার ও পাচারকারীদের সঠিক সময়ে তথ্য শেয়ার এবং অধিক সচেতনতার মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সতর্ক ও দৃঢ় থাকার বিষয়ে দুই পক্ষ সম্মত হয়েছে।
সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ২১ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, সড়ক বিভাগ, ভূমি জরিপ অধিদপ্তর, যৌথ নদী কমিশন এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও প্রতিনিধিত্ব করেন।
অপরদিকে, বিএসএফ মহাপরিচালক দালজিৎ সিং চৌধুরীর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধিদল সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। ভারতীয় প্রতিনিধিদলে বিএসএফের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়াও ভারতের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তারাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
উভয় পক্ষ কোনো ধরনের আকাশসীমা লঙ্ঘন না করার বিষয়ে একমত হয়। ভবিষ্যতে যাতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না ঘটে সেজন্য পূর্বনির্ধারিত ফ্লাইট সম্পর্কে সঠিক সময়ে তথ্য শেয়ারের মাধ্যমে পরস্পরকে অবহিত করার বিষয়ে সম্মতি জানায়।
নিজ নিজ দেশের গণমাধ্যমে পরস্পরবিরোধী বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার, গুজব ছড়িয়ে সীমান্তে যাতে কোনো উত্তেজনা সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে উভয় দেশের গণমাধ্যমকে পরামর্শ প্রদানের বিষয়ে একমত হয় দুই পক্ষ।
বিজিবি-বিএসএফ সীমান্তবর্তী জনগণকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, মানবপাচার, সীমান্ত স্তম্ভ উপড়ে ফেলা ও অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত অপরাধ থেকে বিরত রাখার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে একমত হয়।
বিজিবি ও বিএসএফ সীমান্ত শূন্যরেখা থেকে ১৫০ গজের মধ্যে পূর্ব অনুমোদন ছাড়া কোনো উন্নয়নমূলক কাজ না করার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এলাকায় চলমান উন্নয়নমূলক কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করার বিষয়ে একমত হয়। এছাড়া যৌথ নদী কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত নদীর তীর সংরক্ষণ কাজ সহজতর করা এবং সীমান্তবর্তী অভিন্ন নদীগুলোতে অননুমোদিত কাজ বন্ধ রাখার ব্যাপারে একমত হয়।
এ ছাড়াও ‘কানেক্টেড বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় তিনবিঘা করিডরের মাধ্যমে দহগ্রামকে সংযুক্ত করার জন্য অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার বিষয়ে বিএসএফ মহাপরিচালক ভারতের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সংস্থার কাছে উপস্থাপন করে তা সমাধানের আশ্বাস দেন।
উভয় প্রতিনিধিদল আন্তঃসীমান্তে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী অবস্থান করলে সে ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে এবং সঠিক সময়ে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে একমত হয়।