মানাসলু পর্বত জয় করলেন তানভীর ও বাবর আলী

বিশ্বের অষ্টম উচ্চতম পর্বত মানাসলুর চূড়ায় লাল-সবুজের পতাকা উড়ালেন কিশোরগঞ্জের তরুণ পর্বতারোহী তানভীর আহমেদ। সুউচ্চ পর্বতারোহণে বিদেশ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক মাউন্টেইনিয়ারিং কোর্স আবশ্যক, এমন ধারণা ভেঙে দিয়ে প্রবল সাহস ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে তিনি দেশের পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিয়েই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে দুর্গম মানাসলু জয় করে নজির স্থাপন করেছেন। তার সঙ্গী ছিলেন চট্টগ্রামের ডা. বাবর আলী।
২৬ হাজার ৭৮১ ফুট (আট হাজার ১৬৩ মিটার) উচ্চতার দীর্ঘ কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে শুক্রবার (২৬ সেপ্টম্বর) ভোরে মানাসলুর চূড়ায় আরোহণ করেন তানভীর আহমেদ ও বাবর আলী। এদিন প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই আট হাজার মিটার উচ্চতার কোনো পর্বত জয় করে আরেক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন বাবর আলী। এর আগে এভারেস্ট, লোৎসে ও অন্নপূর্ণা-১ জয় করার কৃতিত্ব রয়েছে তার। দীর্ঘ কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে গতকাল শুক্রবার ভোরে তারা মানাসলুর চূড়ায় আরোহণ করেন। স্থানীয় দুই গাইড বীরে তামাং ও ফূর্বা অংডি শেরপা দুই পর্বতারোহীকে চূড়ায় উঠতে সহায়তা করেন।
এ অভিযানে সফল হয়ে তানভীর আহমেদ একটি প্রচলিত ধারণা ভেঙে প্রমাণ করেছেন, এই ধরনের উচ্চ পর্বতে উঠতে বিদেশে প্রাতিষ্ঠানিক মাউন্টেইনিয়ারিং কোর্স অত্যাবশ্যক নয়। প্রবল সাহস, ইচ্ছাশক্তি ও দেশের বিভিন্ন উঁচু পর্বতে আরোহণ করে নিজে নিজেই প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
সফল অভিযান শেষে বাবর আলী বলেন, এখন তার স্বপ্ন বিশ্বের ১৪টি আট হাজার মিটারের শৃঙ্গের সবক’টি জয় করা। এখন পর্যন্ত আট হাজার মিটারের চারটি জয় করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। অন্যদিকে তানভীর আহমেদ জানান, এভারেস্ট জয়সহ নতুন নতুন অভিযানে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করাই তার লক্ষ্য।
‘মানাসলু অ্যাসেন্ট : ভার্টিক্যাল ডুয়ো’ শীর্ষক এ অভিযানের আয়োজন করে পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স। এ অভিযানে তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে একাধিক প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে রয়েছে সামুদা, ভিজুয়াল নিটওয়ারস, গিগাবাইট বাংলাদেশ, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন, সিনোভেস্ট, সিয়েরা-রোমিও, আদিবা ফুটওয়্যার, ফোরএস অ্যাডভান্স টেকনোলজিস, জেনোভার্স, সোর্স এসোসিয়েটস, আইলেট ব্যাংকার্স, কাজী এগ্রো ও ফ্রিয়েসভা।
অভিযানের ব্যবস্থাপক ফরহান জামান বলেন, একই দিনে দুবার মানাসলুর চূড়ায় উড়েছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। বাংলাদেশ সময় ভোর পৌনে ৪টার দিকে মানাসলুর শীর্ষে লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন তানভীর আহমেদ। আর ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে পৃথিবীর অষ্টম শীর্ষ পর্বত মানাসলুতে এই কীর্তি গড়েন বাবর আলী।
ফরহান জামান বলেন, পর্বতারোহী তানভীরের এটি প্রথম আট হাজার মিটার উচ্চতার পাহাড়ে অভিযান। ইতোপূর্বে আট হাজার মিটারের পর্বত চূড়ায় সফল সব বাংলাদেশি পর্বতারোহীই পর্বতারোহণের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছিলেন। কারণ সবার ধারণা ছিল, অতি উচ্চ পর্বতে সফলতা পেতে বিদেশে গিয়ে মাউন্টেনিয়ারিং কোর্সের বিকল্প নেই। তানভীর এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, এ ধরনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি। ওর সম্বল দেশে সীমিত সুবিধার মধ্যে অনুশীলন আর ইচ্ছাশক্তি। তাই মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স সংক্রান্ত ওই ধারণা আমরা তাকে দিয়ে ভাঙতে চেয়েছি।

তানভীর আহমেদ ও বাবর আলী বাংলাদেশ থেকে নেপালে গিয়েছেন গত ৫ সেপ্টেম্বর। গত ৭ সেপ্টেম্বর তারা কাঠমান্ডু থেকে গাড়িতে যান তিলচে গ্রামে। এরপর পাঁচ দিন হেঁটে তারা পৌঁছে যান বেসক্যাম্পে। সেখানে দুদিন বিশ্রাম নিয়ে তারা শুরু করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া। প্রথম দফা ক্যাম্প-১ (পাঁচ হাজার ৭০০ মিটার) এ এক রাত কাটিয়ে তারা নেমে আসেন। একদিন বিশ্রামের পর দ্বিতীয় দফা আরোহণে তানভীর ক্যাম্প-২ (ছয় হাজার ৩০০ মিটার) এবং বাবর ক্যাম্প-৩ (ছয় হাজার ৭০০ মিটার) এ রাত কাটিয়ে শেষ করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর্ব।
গত ২২ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত অভিযান শুরু হলে তানভীর বেসক্যাম্প থেকে যাত্রারম্ভ করে উঠে আসেন ক্যাম্প-১ এবং পরদিন উঠে আসেন ক্যাম্প-২।
এদিকে, বাবর একদিন পর রওনা দিয়ে সরাসরি উঠে আসেন ক্যাম্প-২ এ। গত ২৪ সেপ্টেম্বর দুজনেই ক্যাম্প-৩ এ রাত কাটিয়ে পরদিন দুপুর নাগাদ পৌঁছে যান ক্যাম্প-৪ এ (সাত হাজার ৪০০ মিটার)। বাকি বেলা বিশ্রাম করে রাত নামতেই শুরু হয় তাদের চূড়ার দিকে যাত্রা। আর ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরেই তারা পৌঁছে যান পর্বত শীর্ষে। কিছুক্ষণ অবস্থান করে তারা নামতে শুরু করেন।

মানাসলু পশ্চিম-মধ্য নেপালের মানসিরি হিমালে অবস্থিত। সংস্কৃত শব্দ ‘মনসা’ থেকে নামটির উৎপত্তি, যার অর্থ ‘বুদ্ধি’ বা ‘আত্মা’। তাই মানাসলু মানে দাঁড়ায় ‘আত্মার পর্বত’। ১৯৫৬ সালে জাপানি পর্বতারোহী তোশিও ইমানিশি ও গ্যালজেন নরবু প্রথম এই পর্বতের চূড়ায় পৌঁছেন। উচ্চতায় এটি অষ্টম হলেও বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী পর্বতগুলোর মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে।
‘ভিএফ এশিয়া বাংলাদেশ’র অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত তানভীর কিশোরগঞ্জ সদরের খরমপট্টি নিবাসী অ্যাডভোকেট তারেক উদ্দিন আহমদ এবং শিক্ষিকা শিরীন আহমেদ দম্পতির প্রথম সন্তান। তানভীর এক কন্যা সন্তানের বাবা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির ২০০৬ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচে এমবিবিএস পাস করা ডা. বাবর আলী চট্টগ্রামের হাটহাজারি উপজেলার নজুমিয়া হাটের লেয়াকত আলী এবং লুৎফুন্নাহার বেগমের দ্বিতীয় সন্তান। তিনি ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের সাধারণ সম্পাদক। তানভীর আহমেদ একই ক্লাবের মাউন্টেনিয়ারিং সম্পাদক।