জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় এককক্ষের সবাই ফেল!

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত একটি কলেজ থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এককক্ষের একই বিষয়ের সব শিক্ষার্থীই অকৃতকার্য হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। শিক্ষার্থীরা বলেছেন, এটা কোনোভাবেই সম্ভব না, এটা অস্বাভাবিক। কলেজ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে অবগত করলেও এখনো এ ব্যাপারে কোনো ফয়সালা পাওয়া যায়নি। ফলে শিক্ষার্থীদের পুনরায় ফরম ফিলাপ করতে হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ইসলামপুর আলহাজ কাজী রফিকুল ইসলাম স্কুল অ্যান্ড কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে এ ঘটনা ঘটেছে। ওই বিভাগের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৭ জন। স্নাতক সম্মানের চূড়ান্ত পরীক্ষায় একইকক্ষে পরীক্ষা দেন ২৪ জন। তাঁদের সবাই ‘সামাজিক পরিবর্তন’ বিষয়ে ‘এফ গ্রেড’ পেয়েছেন অর্থাৎ ফেল করেছেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানান, প্রতি বছরই এই ধরনের অভিযোগ তারা পান। নিয়ম অনুযায়ী যা যা করার দরকার তারা তাই করেন। ইচ্ছে করে কাউকে পাস বা ফেল করানোর কোনো সুযোগ এখানে নেই।
গত ২১ জুন এনটিভি অনলাইনে ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতুড়ে ফেলের আছর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে নরসিংদী সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের চূড়ান্ত পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়।
সেখানে ‘প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট’ বিষয়ে বিভাগের ১৮ জন পরীক্ষার্থী এককক্ষে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁরা সবাই ফেল করেছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাঁদের ফলাফল দেখিয়ে দাবি করেন, স্নাতক সম্মান শ্রেণির প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বের পরীক্ষায় তাঁরা সবাই প্রথম শ্রেণির নম্বর পেয়েছেন। তাঁরা বিষয়টিকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে দাবি করেন।
এনটিভি অনলাইনের সেই প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তাদের অভিযোগের কথা জানান। সেই সূত্র ধরেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইসলামপুর আলহাজ কাজী রফিকুল ইসলাম স্কুল অ্যান্ড কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিষয়টি সামনে আসে।
ইসলামপুর আলহাজ কাজী রফিকুল ইসলাম স্কুল অ্যান্ড কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ফেল করা ‘ভুক্তভোগী’দের একজন তাসমিয়া রহমান সুপ্তি। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে সেই বিষয়ে অনার্স না থাকায় শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দুরে ইসলামপুর আলহাজ কাজী রফিকুল ইসলাম স্কুল অ্যান্ড কলেজে পছন্দের বিষয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ২০১১-১২ সেশনে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষে কোনো বিষয়েই ফেল করেননি। ২০১৫ সালের চতুর্থ অর্থাৎ চূড়ান্ত পরীক্ষা দেন। আশা করছিলেন, ভালভাবে পাশ করবেন। পরীক্ষার ফলাফল বের হয় ২০১৭ সালের ১৪ মে। তখন জানতে পারেন অন্য সব বিষয়ে পাশ করলেও তিনি ‘সামাজিক পরিবর্তন’ বিষয়ে ফেল করেছেন।
তাসমিয়া রহমান সুপ্তি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি সব বিষয়ে পরীক্ষা ভাল দিয়েছি। সামাজিক পরিবর্তন খুব কঠিন বিষয় নয়। এই বিষয়ে ফেল করাটা অনেকটা অস্বাভাবিক। আমি নিজেও ভাবতে পারছি না আমি কেন এই বিষয়ে ফেল করলাম। শুধু আমি না, এককক্ষে যারা ছিলাম সবাই ফেল করছি এই বিষয়েই।’
কলেজ কর্তৃপক্ষের পরামর্শে সুপ্তিও সবার মতোই ফলাফল নিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছেন। এক মাসের মধ্যে বিষয়টি ফয়সালা করার সাধারণ নিয়ম থাকলেও এখনো কোনো জবাব পাননি। তিনি বলেন, ‘আমার বাসায় অনেক সমস্যা হচ্ছে। আমার বাবা আমাকে অনেক কথা বলতাছে, আমি কী করব নিজেই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে লাইফটা শেষ হয়ে গেছে।’
একই বিভাগের আরেক ‘ভুক্তভোগী’ সুমনা সাহা। তিনি প্রথম বর্ষে দ্বিতীয় শ্রেণি, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ফলাফলে পেয়েছেন প্রথম শ্রেণি। কিন্তু চতুর্থ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার ‘সামজিক পরিবর্তন’ বিষয়ে ফেল করেছেন।
এই বিষয়ে কীভাবে খারাপ ফল এলো বুঝতে পারছেন না সুমনা সাহা। তাঁর দাবি, পরীক্ষা দিয়ে যা প্রত্যাশা করি, তার থেকে হয়তো একটু এদিক-সেদিক হয়। কিন্তু ফেল করার পরীক্ষা তিনি দেননি।
ফলাফল নিরীক্ষণের আবেদন করা হয়েছে উল্লেখ করে সুমনা সাহা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, এক মাসের বেশি হয়ে গেছে এখনো ফলাফল আসেনি। ১৩ জুলাই চূড়ান্ত পরীক্ষার ফরম ফিলাপের শেষ তারিখ ছিল। ফলে আমরা আবার সবাই ফরম ফিলাপ করেছি।
‘জাতীয় বিশ্ববিদালয়ে ফোন দিলে তাঁরা বলে, তোমরা অপেক্ষা কর। ফলাফল আসতে পারে, আর ফরম ফিলাপ করে ফেল। ফরম ফিলাপের সঙ্গে নাকি ফলাফলের কোনো সম্পর্ক নেই’, যোগ করেন সুমনা সাহা।
ফলাফল খারাপ হওয়ার প্রভাব ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনেও পড়েছে বলে দাবি করেন সুমনা সাহা। তিনি বলেন, ‘অনেকেইঅসুস্থ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ মেয়েদেরই বিয়ে হয়ে গেছে, তাদের স্বামীরা এখন বলছে, এই রেজাল্ট নিয়ে পড়াশুনা করার কী দরকার। আমার পরিবার জানে না, যদি জানে লাইফ শেষ হয়ে যাবে।’
‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমাদের একটাই চাওয়া, আমাদের রেজাল্ট যেটাই হোক, রেজাল্টটা দিয়ে দিক। আমরা নিরীক্ষণের যে আবেদন করেছি, সেটা তাড়াতাড়ি প্রকাশ করা হোক’, যোগ করেন সুমনা সাহা।
এ ব্যাপারে ইসলামপুর আলহাজ কাজী রফিকুল ইসলাম স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার কলেজে এমন অনেকে ফেল করেছে। এ কারণে জাতীয় বিশ্ববিদালয়ে আমরা মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছি প্রায় এক মাস আগে।’
ইসলামপুর আলহাজ কাজী রফিকুল ইসলাম স্কুল অ্যান্ড কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যপক মো. জুরু মিয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের বিভাগ থেকে ৩৭ জন পরীক্ষা দিয়েছিল, তার মধ্যে ২৪ জন ফেল করেছে। ছাত্রছাত্রীরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এর জন্য আবেদন করেছে।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
একই কক্ষের একই বিভাগের সব পরীক্ষার্থীর ফেল করার ব্যাপারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বদরুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি আসলে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিকের কিছু নয়। আমাদের যে সিস্টেম সে অনুযায়ী পরীক্ষার পর আমরা খাতাগুলো ভাগ করে দেই, তা বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকরাই দেখেন। কাজেই তাঁদের ওপর আমারদের নির্ভর করতে হয় ফলাফলের জন্য। সে কারণে খাতায় যদি কেউ ফেল করে তাকে পাস করানোর সুযোগ আমার নাই। তাঁর পরও আমরা দেখব এমন কোনো অসঙ্গতি আছে কি না, এমন কিছু অভিযোগ আমাদের কাছেও এসেছে।’
ফলাফল কবে প্রকাশ করা হতে পারে জানতে চাইলে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, ‘এটা বলা সম্ভব নয়। কারণ এটা একটা লম্বা প্রসেস, খাতাগুলো সারা দেশে ছড়ানো থাকে তা আনতে সময় লাগে। এ বছরে ১৫ দিনের ছুটির কারণে একটু বেশি সময় লাগছে। ছাত্রছাত্রীদের কোনো ক্ষতি হবে এমন কাজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় করে না। অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা এখন অনেক এগিয়ে আছি।’