জাকসু নির্বাচন : সাইবার বুলিং ও সামাজিক হেনস্তা, প্রার্থিতায় অনাগ্রহ নারীদের

আসন্ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে বর্তমান নানা বাস্তবতায় নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত হয়েছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ভোটারদের মধ্যে অর্ধেক নারী। তবুও সাইবার বুলিং, সামাজিক হেনস্তা, চরিত্রহনন, ব্যক্তিগত আক্রমণ, ছবি বিকৃতির ভয়, পরিবার-সমাজ থেকে নিরুৎসাহিত করা, সমান সুযোগ সুবিধার অভাব, পুরুষ-প্রধান রাজনীতির সংস্কৃতি ও অনুকূল পরিবেশের অভাবকে দায়ী করছেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আসন্ন জাকসু নির্বাচনে নারীদের অনাগ্রহের পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, ৩৩ বছর পর জাকসু নির্বাচন হওয়ায় অনেকের মধ্যে পরিষ্কার ধারণা নেই। আবার সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণের কারণে অনেকেই এটিকে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখছে। তাই অনেকেই প্রার্থী হতে অনীহা প্রকাশ করছেন।
তারা জানান, নির্বাচনে প্রার্থিতায় অনীহার বড় একটি কারণ হলো সাইবার বুলিং ও সামাজিক হেনস্তা। চরিত্রহনন, গুজব, প্রপাগাণ্ডা, ছবি বিকৃতির ভয় নারীদের নির্বাচন থেকে দূরে রেখেছে। এছাড়াও পরিবার বা আত্মীয় স্বজনদের থেকে অনাগ্রহ, আপত্তি ও নিরুৎসাহিত করা, নির্বাচনে অনুকূল পরিবেশের অভাব এবং সমান সুযোগ-সুবিধার অভাব তাদের নির্বাচনবিমুখ করেছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক নারী শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ বলছেন, বিগত জুলাই আন্দোলনের পর থেকে দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে একাধিক নারী নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। কিন্তু তারাও সাইবার বুলিং ও সামাজিক হেনস্তার শিকার হওয়া থেকে দূরে থাকতে পারেননি। সেই জায়গায় জাকসু নির্বাচনে নির্দিষ্ট কোনো প্যানেলে যুক্ত হয়ে নির্বাচন করা তাদের জন্য দুরূহ ব্যাপার বলেই মনে করছেন কেউ কেউ।
আসন্ন জাকসু নির্বাচনে 'শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম' প্যানেল থেকে এজিএস (ছাত্রী) প্রার্থী মালিহা নামলাহ বলেন, ‘নারীদের প্রার্থী না হওয়ার পিছনে প্রধান কারণ হলো সাইবার বুলিং ও হেনস্তা। সবক্ষেত্রে সমান সুযোগ সুবিধা না পাওয়াও প্রধান কারণ। ব্যক্তিগত আক্রমণ, প্রপাগাণ্ডা, চরিত্রহননের ভয় তো থাকেই। এছাড়াও ছাত্ররাজনীতি নিয়ে অনীহা এবং পরিবার বা আত্মীয় স্বজন থেকে অনীহা এবং আপত্তির কারণেও নারীরা ফ্রন্ট লাইনে আসতে চায় না।’
মালিহা নামলাহ আরও বলেন, ‘যদি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায় এবং বিভিন্ন সেমিনার বা ক্যাম্পেইন আয়োজন করা যায় তাহলে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে। এছাড়াও সাইবার বুলিংকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করলে এবং সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করলে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।’
'সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট' প্যানেল থেকে এজিএস (ছাত্রী) প্রার্থী আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা বলেন, ‘‘নারীদের নেতৃত্বে না আসার প্রধান কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। কোনো নারী যখন নেতৃত্বে আসতে চায়, তখন সাইবার বুলিং, ট্যাগিং, ব্যাশিংয়ের শিকার হয়। চরিত্র তুলে কথা বলা হয়। ইসলামী মতাদর্শের হলে 'ছাত্রীসংস্থার' বলা হয় আর মুক্তমনা হলে 'শাহাবাগী গোসল কর' বলা হয়৷’’
আয়েশা সিদ্দিকা আরও বলেন, ‘একজন নারী যখন নেতৃত্বে আসতে চান, তখন তার পরিবার চিন্তা করে তার মেয়ের সঙ্গে নোংরামো হবে। এই একটি মাত্র ভয়ে মেয়েরা ইচ্ছা এবং যোগ্যতা থাকার পরেও পরিবারের বাধার কারণে সামনে আসতে পারে না।’
এদিকে জাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে নারীদের অনাগ্রহের কারণে কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ এবং হল সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী সংকট দেখা দিয়েছে। মেয়েদের অধিকাংশ হলে একাধিক পদে কোনো প্রার্থী পাওয়া যায়নি, ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘাটতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মেয়েদের হলে প্রার্থী সংকট, একাধিক পদ শূন্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ২১টি আবাসিক হলে জাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি চললেও ছেলেদের ১১টি হলের প্রায় সব পদে একাধিক প্রার্থী নমিনেশন জমা দিয়েছেন।
অন্যদিকে মেয়েদের হলে চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা- কোনো হলে ৬টি, কোথাও ১০টি আবার কোনো কোনো হলে ১১টি পদে মনোনয়নপত্র বিক্রি হলেও বহু পদ শূন্য থেকে গেছে।
জাকসু নির্বাচনে এবার কেন্দ্র ও হল মিলিয়ে মোট ৮১৩টি মনোনয়নপত্র বিতরণ করা হলেও নমিনেশন জমা পড়েছে মোট ৭৪০টি। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে জমা হয়েছে ২৭৩টি এবং হলভিত্তিক জমা পড়েছে মোট ৪৬৭টি মনোনয়নপত্র।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী-কেন্দ্রীয় সংসদের জন্য ২৯৯টি মনোনয়নপত্র দেওয়া হলেও জমা হয়েছে ২৭৩টি। অন্যদিকে হল পর্যায়ে ৫১৪টি মনোনয়ন বিতরণ করা হলেও জমা পড়েছে ৪৬৭টি।
জাকসু নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, মেয়েদের হলগুলোর মধ্যে জাহানারা ইমাম হলে মনোনয়ন জমা পড়েছে ১৬টি, প্রীতিলতা হলে ১৩টি এবং বেগম খালেদা জিয়া হলে ১১টি। বেগম সুফিয়া কামাল হলে জমা পড়েছে ১০টি মনোনয়নপত্র। ১৩ নম্বর ছাত্রী হল (সাবেক শেখ হাসিনা হল) ও নওয়াব ফয়জুন্নেছা হলে জমা পড়েছে সর্বনিম্ন সংখ্যক মাত্র ৬টি করে মনোনয়ন।
অন্যদিকে, ১৫ নম্বর ছাত্রী হল (সাবেক বঙ্গমাতা হল), রোকেয়া হল ও বীর প্রতীক তারামন বিবি হলে জমা পড়েছে ১৭টি করে মনোনয়নপত্র। আর বেগম ফজিলাতুন্নেছা হলে জমা পড়েছে মোট ১৫টি মনোনয়ন।
এদুদি জাকসু নির্বাচনে পুরুষ প্রার্থীদের তুলনায় নারী প্রার্থীদের অংশগ্রহণ সীমিত হওয়ায় ক্যাম্পাসে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনের পরিবেশ নারী শিক্ষার্থীদের জন্য অনুকূলে নয় এবং সাইবার বুলিং, সামাজিক হেনস্তাসহ প্রতিনিয়ত ট্যাগিং ও ব্যাশিংয়ের শিকার হচ্ছেন নারী শিক্ষার্থীরা। এতে করে ছাত্ররাজনীতি বা নির্বাচন থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
অন্যদিকে শিক্ষকরা বলছেন, কাঠামোগত পরিবর্তন, পরিবার ও সমাজ থেকে নিরুৎসাহিত করা ও জাকসু নির্বাচন সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকায় নারী শিক্ষার্থীরা নির্বাচনবিমুখ হতে পারেন।
সার্বিক বিষয়ে জাকসু নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের কাছে নারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তা বা সাইবার বুলিংয়ের কোনো অভিযোগ এখনো আসেনি। অভিযোগ এলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান আরও বলেন, ‘দীর্ঘ ৩৩ বছর পরে আমরা জাকসু নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছি। এখানে সবাইকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। কাউকে হেনস্তা করা বা সাইবার বুলিং করে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা কারো কাম্য নয়। এছাড়াও তিনি নির্বাচন আয়োজনে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।’