বাংলাদেশের প্রেমে পড়লেন পাকিস্তানি ভ্লগার রুবিনা মারুফ

ভিনদেশে জন্ম, কিন্তু হৃদয়ের টান ছিল বাংলাদেশের প্রতি। বাবা ছিলেন যশোরের মানুষ, মা পাকিস্তানি। আর সেই দুই সংস্কৃতির মিলনস্থলে দাঁড়িয়ে রুবিনা মারুফ যেন এক সেতুবন্ধন—পাকিস্তানি ভ্লগার হয়েও হৃদয়ের গভীর থেকে অনুভব করেন বাংলাদেশের টান।
এই টানেই তিনি ছুটে এসেছেন বাংলাদেশে—একটি শেকড় খোঁজার যাত্রায়। ছয় মাসের ভিসা হাতে নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন পাকিস্তান থেকে। উদ্দেশ্য শুধু ভ্রমণ নয়, বরং নিজের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস, আবেগ আর স্মৃতির ধুলোকে নিজের চোখে দেখা।

পথ চলার গল: শহর থেকে শেকড়ে
রুবিনার প্রথম গন্তব্য ছিল যশোর—তার দাদাবাড়ি। এই শহর তাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি ঘুরেছেন যশোরের মাছ বাজার, নৌকায় চড়েছেন, গিয়েছেন স্থানীয় বোর্ড ক্লাবে, এমনকি পূর্বপুরুষদের কবরেও জিয়ারত করেছেন। সেই মুহূর্তগুলো তাকে নতুনভাবে ছুঁয়ে গেছে।

তিনি বলেন, “যশোর অনেক পুরনো শহর, এখানে যা দরকার সবকিছুই আছে। কিছু জায়গায় তো পাকিস্তানের অনেক প্রদেশের চেয়ে যশোর অনেক এগিয়ে।”

শাড়ি, শেকড় আর স্মৃতি
যশোরে এসেই রুবিনা পড়েছেন তার দাদীর রেখে যাওয়া একটি শাড়ি। যদিও বলেন, “আমি শাড়ি ঠিকমতো সামলাতে পারি না, কিন্তু পরতে ভীষণ ভালো লাগে। পাকিস্তানে শাড়ির দাম অনেক বেশি, কিন্তু এখানে শাড়ির আবেগটাই আলাদা।”
সেই শাড়ি যেন শুধু এক কাপড় নয়, এক স্মৃতির গন্ধে ভরা উত্তরাধিকার—যা তাকে আবারও শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত করে।

চট্টগ্রামের পাহাড়ে আবিষ্কার
ঢাকা ও যশোর ঘোরার পর রুবিনা চলে যান চট্টগ্রামে। তিনি ঘুরেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, পাহাড়, ঝর্ণা, আর পরকি বিচ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশ তাকে মোহিত করেছে। রুবিনা বলেন, “এমন পরিবেশে প্রতিদিন পড়াশোনা করা এক ধরনের সৌভাগ্য।”

স্বাদে স্মৃতি, পাতে গল্প
রুবিনার খাবার পছন্দের তালিকাটা বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। তিনি ভালোবাসেন খিচুড়ি, শামি কাবাব, বিরিয়ানি, আর সবচেয়ে বেশি যশোরের ব্রাউন রঙের মিষ্টি। তবে ঢাকার বিখ্যাত হাজির বিরিয়ানি তাকে তেমন আকর্ষণ করেনি। তিনি বলেন, “বিরিয়ানি ভালোবাসি, তবে অত তেল মশলা আমার পছন্দ না।”
এখানে খাবারের সঙ্গে থাকে একাধিক ডিশ—এই ব্যাপারটিও তার কাছে নতুন। তবে যেটা তিনি ভীষণ মিস করেন, তা হলো পাকিস্তানি রুটি।
ইলিশ মাছের স্বাদ তার ভালো লাগলেও কাঁটার জন্য সেটি পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেন না। তবু বাংলাদেশের খাবার নিয়ে তার আগ্রহ ও ভালোবাসা সত্যিই চোখে পড়ার মতো।

পারিবারিক গল্প: যাকে হারিয়েছেন, যাদের নিয়ে স্বপ্ন
রুবিনার বাবা যশোর ছেড়েছেন ১৯৬৮ সালে, এরপর চলে যান পাঞ্জাবে। সেখানেই তার বিয়ে হয়। রুবিনারা তিন বোন এক ভাই। তবে ভাইটি মারা গেছেন মাত্র ২২ বছর বয়সে। সেই শূন্যতা রুবিনাকে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে।
বর্তমানে তিনি করপোরেট জগতে কর্মরত, তবে জীবনের ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করে নিজের শেকড়ের কাছে ফিরে আসতে পেরেছেন—এটা তার জীবনের সবচেয়ে আবেগঘন অধ্যায়।
তিনি চান, ভবিষ্যতে আবার বাংলাদেশে আসবেন, তবে এবার বাবাকে নিয়ে আসবেন। দেখাবেন যশোরের সেই বাড়ি, সেই পুকুর, সেই স্কুল—যেখানে তার বাবার ছেলেবেলা কেটেছে।

দেশ, মানুষ ও হৃদয়ের সংযোগ
বাংলাদেশে এসে সবচেয়ে বড় যে অভিজ্ঞতাটি রুবিনার হয়েছে, তা হলো এদেশের মানুষের আন্তরিকতা।
“মানুষগুলো এত আন্তরিক, এত খোলা মনের! আমি কোথাও একা বোধ করিনি। সবাই আপন করে নিয়েছে,” বলেন রুবিনা।
তিনি কৃতজ্ঞ বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতি, যারা সহজ ও আন্তরিক সহযোগিতা করেছে তাকে ভিসা পেতে। তবে তার অভিমত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যদি সরাসরি বিমান চলাচল থাকত, তাহলে দুই দেশের মানুষের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হতো।

শেষ কথা: দুই সংস্কৃতির মাঝে এক উষ্ণ স্পর্শ
রুবিনা মারুফ শুধু একজন ভ্লগার নন, তিনি দুই দেশের মাঝে এক মানবিক গল্প। পাকিস্তানি হয়েও তার হৃদয়ের অনেকটা জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের মাটি, ভাষা, মানুষ আর রান্নার গন্ধ।

তার যাত্রা প্রমাণ করে—শেকড় কখনো মুছে যায় না। সেটা হয়তো দূরে থাকে, হয়তো ভুলে যাওয়া হয়, কিন্তু একদিন না একদিন—সেই শেকড়ই ডাকে।
রুবিনা সেই ডাকে সাড়া দিয়েছেন, হৃদয়ের পথ বেয়ে ফিরে এসেছেন তার পূর্বপুরুষের মাটিতে—যেখানে সবকিছুই অপরিচিত, অথচ কোথাও যেন খুব চেনা।