নতুন কেনা ফোনটি সত্যিই নতুন কি না, যেভাবে বুঝবেন
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/11/moblie_phone.jpg)
সুক্ষ্ম কিছু বিষয়ে উদাসীনতার জন্য অনেকেই সদ্য ক্রয় করা স্মার্টফোনটি আসলেই নতুন কিনা, তা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন। প্রায় দেখা যায়, পূর্বে ব্যবহৃত ডিভাইসগুলো ভালোভাবে মেরামত করে বিক্রির জন্য তুলে রাখা হয়। তখন আপাতদৃষ্টিতে এগুলোকে দেখে একদম নতুন মনে হয়। সঙ্গত কারণে, নতুন ফোন কেনার অনেক পরে ক্রেতা আবিষ্কার করেন যে, তার ফোনটি আসলেই নতুন নয়। এজন্য ফোন কেনার সময় কিছু কৌশল অনুসরণ করা জরুরি। চলুন, স্মার্টফোনের নতুনত্বের সত্যতা নিরূপণ করার কিছু ব্যবহারিক পদ্ধতি বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
নতুন কেনা মোবাইল ফোনটি সত্যিই নতুন কিনা তা যাচাইয়ের ১০টি উপায়
ফোনের প্যাকেজিং এবং সিল পরীক্ষা
যেকোনো নতুন পণ্যের মতো নতুন ফোনের ক্ষেত্রেও সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো অক্ষত এবং ভাল-সিল করা প্যাকেজিং। মডেল, রঙ ও আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি) সহ ফোনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদির লেবেলসহ প্যাকেজিংটি বেশ মজবুত থাকে। প্রস্তুতের পর একদম সদ্য মার্কেটে আসা পণ্যগুলোতে প্রায়ই সুরক্ষা সিল থাকে। একবার খুলে ফেললে পুনরায় সিল করার পরেও আগের ভাঙা সিলের চিহ্ন থেকে যায়। তাই ফোনের বাক্সটি সিল বিহীন কিংবা একদম খোলা কিনা তা খুটিয়ে দেখা জরুরি।
যেমন, আইফোনের বাক্সগুলো সাধারণত সিম্লেস প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো থাকে। ভিভোর ডিভাইসগুলোতে ব্র্যান্ডের স্টিকার ব্যবহার করা হয়, যা একবার খুলে ফেলার পর নষ্ট সিল বেশ ভালোভাবে দৃষ্টিগোচর হয়।
ফোনের বাহ্যিক অংশ পর্যবেক্ষণ
কেনার সময় ফোনের নতুনত্ব যাচাইয়ের সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর উপায় হলো ফোনের বডি চেকআপ। ডিভাইসটির বডি বিশেষত স্ক্রিনে কোনো স্ক্র্যাচ, ডেন্ট বা দাগ আছে কিনা তা সাবধানে পরীক্ষা করতে হবে। চার্জিং পোর্ট ও স্পিকার ছিদ্রের মতো জায়গাগুলোতে নজর রাখতে হবে। আগে ব্যবহৃত হলে এই অংশগুলোতে সুক্ষ্ম অসঙ্গতি চোখে পড়বে। ক্যামেরার লেন্সে আঙ্গুলের ছাপ বা হালকা ধুলো জমা থাকা মানেই ফোনটি ইতোমধ্যে একবার খোলা হয়েছে। ওয়ানপ্লাস এবং অপ্পোর মডেলগুলোর ধাতব ফ্রেম এতটাই মসৃণ থাকে যে পূর্ববর্তী ব্যবহারে সৃষ্ট ছোট ছোট বিচ্যুতিগুলো নিমেষেই ধরা পড়ে।
সিরিয়াল নম্বর এবং আইএমইআই যাচাই
প্রত্যেকটি ফোনের জন্য থাকে একটি একক ও অনন্য সিরিয়াল নম্বর এবং আইএমইআই। ফোনের বক্সে দুটো কোডই পাওয়া যায়। তাছাড়া ফোনের সেটিংসে বা (অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসের ক্ষেত্রে) *#০৬# ডায়াল করেও এই কোডগুলো পাওয়া যায়। এই নম্বরগুলো ফোন বক্সের প্রদত্ত নম্বরগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে।
যেমন অ্যাপলের ওয়েবসাইটে একটি ভেরিফিকেশন টুল থাকে যার মাধ্যমে আইফোনের সিরিয়াল নম্বর দিয়ে তার অ্যাক্টিভেশন স্ট্যাটাস যাচাই করা যায়। একইভাবে, ভিভো এবং রিয়েলমিরও ওয়ারেন্টি ও অ্যাক্টিভেশনের তারিখ যাচাইয়ের জন্য অফিসিয়াল ওয়েবসাইট রয়েছে। তথ্যগুলো যথাযথভাবে মিলে না গেলে বুঝতে হবে যে ফোনটি ন্যূনতম একবার হলেও হাত-বদল হয়েছে।
১০০ ভাগ চার্জযুক্ত ব্যাটারি
নতুন ক্রয় করা ফোনের ব্যাটারি স্বাভাবিকভাবেই শতভাগ চার্জ থাকা উচিত। ম্যানুয়ালি চার্জ দেওয়া ছাড়াও ফোনের সেটিংস থেকে ব্যাটারির অবস্থা চেক করা যেতে পারে। ফোন চালু করে দেখার সময় ব্রাইটনেস কম থাকলে তা চার্জ ২০ শতাংশের নিচে থাকার ইঙ্গিত দেয়। তবে এর ওপরে থাকলে ফোনের অপারেটিং সিস্টেম (ওএস) গড়পড়তায় মোটামুটি কার্যক্ষমতা নিয়ে চলতে পারে। বিষয়টি আপাতদৃষ্টে বোঝাটা কঠিন। তাই পুরোপুরি ১০০ শতাংশ আছে কিনা তা ভালোভাবে জেনে সন্দেহ দূর করে নেওয়া উত্তম। অধিকাংশ অ্যান্ড্রয়েড ফোনের জন্য বিভিন্ন ধরনের সহায়ক ডায়াগনস্টিক অ্যাপ বা বিল্ট-ইন ব্যাটারি টুল থাকে।
আভ্যন্তরীণ সফ্টওয়্যার পরীক্ষা
সদ্য বাজারে প্রকাশিত ফোনে ফ্যাক্টরি ইন্সটল করা অ্যাপ এবং ওএস-এর সর্বশেষ সংস্করণ থাকে। থার্ড-পার্টি অ্যাপ, অসংলগ্ন সেটিংস বা পুরানো সফ্টওয়্যার মানেই ফোনটি এর আগে একবার ব্যবহার হয়েছে। প্রাথমিকভাবে কি কি অ্যাপ থাকে তা দেখার সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল হলো ফ্যাক্টরি রিসেট করা।
কোনো কোনো ফোন রিসেট করার পর শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় সিস্টেম অ্যাপ দেখা যাবে। তাই এ ক্ষেত্রে আগে থেকে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ্স থাকাটা ইতোপূর্বে ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়। এছাড়াও অব্যবহৃত ফোনে কখনোই পুরানো সংস্করণের কোনো সফ্টওয়্যার থাকবে না। পুরনো অ্যাপের অর্থ হলো ফোনটি আগে সক্রিয় ছিল এবং মাঝের সময়টিতে অ্যাপটির আপডেট করা হয়নি।
ওয়ারেন্টি এবং অ্যাক্টিভেশনের তারিখ নিরীক্ষা
অ্যাক্টিভেশনের তারিখ ও ওয়ারেন্টি অনুসরণ করে একটি ফোন কবে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল তা বের করা যায়। এই তথ্যাবলি যাচাইয়ের জন্য অধিকাংশ ফোন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব অনলাইন পরিষেবা রয়েছে। ফোনের সিরিয়াল নাম্বার দিয়ে সেই সাইটগুলোতে সংশ্লিষ্ট ফোনের অ্যাক্টিভেশনের তারিখ এবং ওয়ারেন্টি কভারেজ জানা যায়। সাধারণত নতুন বাজারে আসা ফোনের ওয়ারেন্টি কেনার তারিখ থেকে শুরু করে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত থাকবে। শেষ সীমাটি যদি খুব কাছাকাছি হয় তাহলে বুঝতে হবে ডিভাইসটি অনেক আগে থেকেই চালু ছিলো।
মেরামতের কোনো চিহ্ন আছে কিনা তা দেখা
কেসিংসহ পুরো বডির যেকোনো অংশে কোন ধরণের মেরামত করা হলে তা ফোনে ছাপ রেখে যায়। স্ক্রুগুলোতে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে সেগুলোর আশেপাশে ক্ষুদ্র দাগ রয়েছে। কখনও কখনও মেরামতের পর স্ক্রুগুলো ভালোভাবে লাগানো হয় না। অন্যদিকে, নতুন ডিভাইসে কোনরকম স্ক্র্যাচ ছাড়াই যুতসইভাবে স্ক্রু লাগানো থাকে। কোনো কোনো ফোনে স্ক্রুর উপর ক্ষুদ্রাক্ষুদ্র বুশ ব্যবহার করা হয় যা ছিদ্রের সঙ্গে মাপ মতো যুক্ত হয়ে থাকে। কিন্তু পুরাতন ফোনে দেখা যাবে এগুলোর একটি নেই অথবা থাকলেও তার মাপ সমান নয়। এ ছাড়া প্রায় সময় ফোনের আভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশগুলো আনঅফিসিয়াল বা মানহীন যন্ত্রাংশ দিয়ে বদলে দেওয়া হয়। এর ফলে ফোনের দীর্ঘায়ুর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
ফোনের সাথে সরবরাহকৃত সামগ্রী যাচাই
বক্সের ভেতর ফোনের সঙ্গে দেওয়া থাকা অন্যান্য সামগ্রী সুক্ষ্মভাবে যাচাই করা অত্যাবশ্যক। আইফোন, ওয়ানপ্লাস এবং রিয়েলমি-এর মতো শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো ফোন মডেলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আনুষঙ্গিক সামগ্রী সরবরাহ করে। চার্জার, কেবল, অ্যাডাপ্টার, কিংবা ইয়ারফোনের গায়ে ব্র্যান্ডের লোগো দেখা যেতে পারে। ভিভো এবং অনার ডিভাইসগুলোতে থাকা সুনির্দিষ্ট চার্জিং অ্যাডাপ্টারগুলোর প্রতিলিপি করা বেশ কঠিন। তাই নকল দেওয়া হলে তা অচিরেই ধরা পড়ে।
ডায়াগনস্টিক টেস্ট
ফোনের হার্ডওয়্যার এবং সফ্টওয়্যার সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডায়াগনস্টিক টেস্টের গুরুত্ব অপরিসীম। আইফোন ও অ্যান্ড্রয়েড উভয় ধরনের ফোনে স্ক্রিন, সেন্সর এবং ব্যাটারি পরীক্ষা করার জন্য নিজস্ব ডায়াগনস্টিক মেনু এবং টুল রয়েছে। ডিসপ্লে, স্পিকার এবং ক্যামেরা পরীক্ষার দিকেও সতর্ক নজর রাখা প্রয়োজন।
আইফোনের ক্ষেত্রে প্রথমে পাওয়ার-অফ করতে হবে। তারপর এ অবস্থায় ভলিউম আপ ও ডাউন বোতাম দুটি একসঙ্গে চেপে রেখে ফোনকে চার্জে লাগাতে হবে। কিছুক্ষণ পর অ্যাপল লোগো প্রদর্শিত হলে বোতামগুলো ছেড়ে দিতে হবে। তারপর প্রদর্শিত বার্তার নিচে ‘স্টার্ট সেশন’-এ ট্যাপ করলেই ডায়াগনস্টিক মুড সক্রিয় হয়ে যাবে।
অ্যান্ড্রয়েডের জন্য ‘*#*#৪৬৩৬#*#*’-এ ডায়াল করে ব্যাটারিসহ সমগ্র ফোনের পারফর্মেন্সের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানা যাবে। এছাড়া ‘টেস্টএম’ বা ‘ফোন ডক্টর প্লাস’-এর মতো বেশ কিছু অ্যাপ রয়েছে যেগুলো অ্যান্ড্রয়েড সিস্টেমে ডায়াগনস্টিক মুড সক্রিয় করে।
ক্রয়ের রশিদসহ প্রয়োজনীয় নথিপত্র পর্যবেক্ষণ
একটি পণ্যের পাশাপাশি তার খুচরা বিক্রেতার বৈধতা নিরুপণের একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হলো পণ্য ক্রয়ের রশিদসহ সংশ্লিষ্ট যাবতীয় নথিপত্র। প্রসিদ্ধ ব্র্যান্ডগুলোতে বিস্তারিত ইনভয়েসের সঙ্গে ক্যাটালগ ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিপণনের কাগজপত্র দেওয়া হয়। এগুলোর মাধ্যমে ডিভাইস অ্যাক্টিভেশন স্ট্যাটাস এবং পণ্য সংক্রান্ত অন্যান্য ইতিহাস জানা যায়। অনুমোদনবিহীন বিক্রেতারা আনঅফিসিয়াল ফোন বিক্রি করে থাকেন। ফলে এগুলোর সঙ্গে সহায়ক কোনো নথি দেখা যায় না।
এখানে উল্লেখ্য যে, এককভাবে শুধু নথিপত্রের উপর নির্ভর করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ফোনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে যথাযথ তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলোর সঙ্গে নথিপত্রের তথ্য মিলিয়ে দেখা বাঞ্ছনীয়।
সবশেষ, সব মিলিয়ে আপনার সদ্য কেনা নতুন ফোন সত্যিই নতুন বা অব্যবহৃত কিনা তা বোঝার জন্য ফোনের সার্বিক দিকগুলোতে সতর্ক মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। প্যাকেজিং, সিরিয়াল নম্বর ও আইএমইআই, ফোনের বডি এবং ওয়ারেন্টি ও অ্যাক্টিভেশনের তারিখ পর্যালোচনার মাধ্যমে ফোনের ব্যাপারে সঠিক তথ্য বের করা সম্ভব। ফোনের সঙ্গে প্রদত্ত সামগ্রী এবং ডায়াগনস্টিক চেক-আপের মাধ্যমে শনাক্ত করা যায় যে, ফোনটি ইতিপূর্বে ব্যবহার হয়েছে কিনা। উপরন্তু, ক্রয়ের রশিদসহ প্রয়োজনীয় নথিপত্র ডিভাইসের ব্র্যান্ডসংক্রান্ত গুণমান নিশ্চিত করে।