নমিতার ভাঙা ঘরে স্বর্গের সুখ
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/08/16/photo-1439714586.jpg)
যশোর শহরের বারান্দি-মোল্লাপাড়া এলাকায় সুনীল মণ্ডলের বাড়ি। ঠিক বাড়ি নয়; ওপরে টিন আর চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটি ঘর। সেখানেই সারা দিন অপেক্ষায় সুনীল মণ্ডল ও কামনা মণ্ডল। চার বছর পর তাঁদের আদরের নাতি দুর্জয় ঘরে ফিরছে। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষই হচ্ছিল না। গতকাল শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় তার অবসান হলো।
মা নমিতা ছেলেকে রীতিমতো বগলদাবা করেই ঢুকলেন বাড়িতে। আত্মীয়স্বজন আর প্রতিবেশীরা আগেই ভিড় জমিয়েছেন। এর মধ্যেই বাবা, নানা-নানি আর মামারা দুর্জয়ের মাথায় তেল মালিশ করা শুরু করে। পাঁচ বছরের ছোট ভাইটিও জড়িয়ে ধরে তাঁকে। আম কেটে নিয়ে আসেন নানি। সবার চোখেই অশ্রু। নমিতার চোখের অশ্রু একটু পরপরই বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। সবাই তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
আর বাবা দুলাল ভক্ত? বুকে পাথর চেপে রেখেছিলেন যে লোকটি গত চার বছর ধরে। এক ফোঁটা জল গড়াতে দেননি চোখের কোনা দিয়ে, পাছে আরো ভেঙে পড়েন প্রিয়তমা স্ত্রী। জটলার ভেতরেই মাঝে মাঝে এসে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে মালিশ করে যাচ্ছেন। তাঁর আনন্দ বোঝা যাচ্ছে কেবল এটুকুতেই। চার বছর ধরে কষ্ট চেপে রাখতে রাখতে আনন্দের প্রকাশটুকুও যেন ভুলে গেছেন তিনি।
প্রিয় নাতিকে ফিরে পেয়ে আনন্দে কেবলই চোখ ভাসিয়েছেন নানা সুনীল মণ্ডল। কথা বলতে পারছিলেন না।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নানি কামনা মণ্ডল বলেন, ‘চার বছর ধরে রাস্তায় রাস্তায় দাদুকে খুঁজেছি পাগলের মতো। দরগাবাড়ি, মন্দির কোনোকিছু বাদ দিইনি। দুর্জয়ের বড় মামা (সুব্রত মণ্ডল) চাকরি করত। ওরে খুঁজতে খুঁজতে সে চাকরিটিও গেছে। আমার যেটুকু জমি ছিল, সব বিক্রি করে দিছি ওর পেছনে।’
কামনা মণ্ডল আরো বলেন, ‘এই জগতে আমরা ছাড়া আমার জামাইয়ের (দুর্জয়ের বাবা) আর কেউ নেই। রাস্তায় রাস্তায় দৌড়েছি। মনের কষ্ট কাউরে বলতে পারিনি।’
দুর্জয়ের ছোট মামা দেবব্রত মণ্ডল বলেন, ‘ভারতে ওকে পাওয়া গেছে জানার পর থেকে আমরা আর ঘুমাতে পারিনি। চার বছর পর ওকে কাছে পেয়েছি। আজ শান্তিতে ঘুমাব। আমাদের এখনকার মনের অবস্থা কাউকে বোঝাতে পারব না। যারা এই পরিস্থিতে কখনো পড়েনি, তারা বুঝতেও পারবে না।’
দুর্জয়কে ফিরে পেয়ে খুশি প্রতিবেশীরাও। এমনই একজন রেণু বেগম। তিনি বলেন, ‘চার বছর পর ছেলেটা যে শেষ পর্যন্ত ফিরতে পেরেছে, তাতে আমরা খুব খুশি। জলজ্যান্ত একটা ছেলে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল। ওর পরিবারের সদস্যদের দিকে তাকানো যেত না।’
আরেক প্রতিবেশী সেলিনা বেগম বললেন, ‘শেষ পর্যন্ত ছেলেকে ফিরে পাওয়ায় আমরা সবাই খুশি। এখন ও মানুষের মতো মানুষ হোক, সেই দোয়া করি।’
পশ্চিমবঙ্গে আইনি টানাপড়েন শেষ করে গতকাল শনিবার সকালে দুর্জয়কে নিয়ে কলকাতা থেকে রওনা হন তাঁর মা নমিতা দেবী ও মামা সুব্রত মণ্ডল।
শনিবার ভোরে সেখানকার ‘ইচ্ছে’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্ণধার পার্থ সারথী মিত্র জানান, শুক্রবার বেশ খানিকটা রাতে সমাজকল্যাণ দপ্তরের অনুমতি পাওয়ার পরই তাঁরা আইনিভাবে দুর্জকে তার মায়ের হাতে তুলে দেন।
ছেলেকে পেয়ে নমিতা দেবী বলেছিলেন, ‘দীর্ঘ চার বছর পর ছেলেকে কোলে নিয়ে শুক্রবার রাতে শান্তিতে ঘুমিয়েছি।’ এ সময় তিনি কলকাতার সমাজকল্যাণ দপ্তর, স্বরাষ্ট্র দপ্তর, সংবাদমাধ্যম এবং কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ উপদূতাবাসকে বিশেষ ধন্যবাদ জানান।
নমিতা বলেন, ‘ওনাদের সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া দুর্জয়কে ফিরে পাওয়া হয়তো সম্ভব হতো না। আমরা ওনাদের প্রত্যেকের কাছে কৃতজ্ঞ।’
চার বছর আগে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় এক উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছিল দুর্জয়। সেখানে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সে। একপর্যায়ে ঠাঁই হয় পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার মালিপুকুর এলাকার একটি হোমে। সেখানে দুর্জয় নিজের নাম গোপন করে ইন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী নাম ধারণ করে।
ওই হোমে প্রতিনিয়ত নির্যাতন করা হতো বলে একদিন সেখান থেকে পালায় দুর্জয়। তারপর একটি শিশুকল্যাণ সমিতির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটির হাত ধরে দুর্জয়ের স্থান হয় ‘ইচ্ছে’ নামের একটি অনাথ আশ্রমে। সেখানেই গত কয়েক বছর কাটিয়েছে সে। সম্প্রতি কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকায় দুর্জয়কে নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এর সূত্র ধরেই শেষ পর্যন্ত এ কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটল।