চার বছরের প্রতীক্ষা শেষে মায়ের কোলে দুর্জয়

২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে দুর্জয় হারিয়ে গিয়েছিল মায়ের বুক খালি করে। তার অবসান ঘটল চার বছর পর ভারতের মাটিতে, একটি অনাথ আশ্রমে। মা ফিরে পেলেন নাড়িছেঁড়া ধনকে। অবসান হলো ছেলে দুর্জয়েরও জীবনের সব দুঃখ-বঞ্চনার। মা নমিতা দেবী ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অনবরত কেঁদে চলেছেন। ছেলে দুর্জয়ের চোখেও আনন্দ অশ্রু। মা-ছেলের পুনর্মিলনের এই অভূতপূর্ব দৃশ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার যাঁরা কলকাতার উপকণ্ঠে কামালগাজী এলাকার ‘ইচ্ছে অনাথ আশ্রমে’ সাক্ষী ছিলেন, তাঁদের চোখও ভিজেছে আবেগে।
চার বছর আগে এক ঈদ উৎসবে পরিবারের সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় এসে খেলতে খেলতে নিজের অজান্তেই ভারতে ঢুকে পড়েছিল বাংলাদেশের যশোরের বাসিন্দা দুর্জয়। দুর্জয়ের বাবা দেশে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন। দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে, সীমান্ত পেরোতেই দুর্জয় পড়ে যায় পাচারকারীদের খপ্পরে। তারপর ঠাঁই হয় পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার মালিপুরুর এলাকার একটি হোমে। সেখানে অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন। সব নীরবে সহ্য করেছে দুর্জয়। এমনকি কেউ যাতে তাকে বাংলাদেশি বুঝতে না পারে, সে জন্য ভয়ে দুর্জয় নাম গোপন করে হয় ‘ইন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী’। একদিন সুযোগ বুঝে পালিয়ে যায় হোম থেকে।
তারপর একটি শিশুকল্যাণ সমিতির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটির হাত ধরে দুর্জয়ের স্থান হয় ‘ইচ্ছে অনাথ আশ্রমে’। সেখানেই গত কয়েক বছর কাটিয়েছে দুর্জয়। এখন সে মায়ের দেখা পেয়েছে। ফিরতে যাচ্ছে তার আপন দেশে। কিন্তু তার আগে কিছু সরকারি নিয়মকানুন শেষ করতে হবে দুর্জয়ের পরিবারকে।
আজ শুক্রবার দুপুরে ‘ইচ্ছে অনাথ আশ্রমে’র কর্ণধার পার্থ সারথি মিত্র টেলিফোনে এনটিভি অনলাইনকে জানান, ‘দুর্জয়কে আমরা তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে চাই। কিন্তু আমাদের ইচ্ছাই তো শেষ কথা নয়। আমরা ওকে পেয়েছিলাম সরকারের হাত থেকে। তাই সরকার অনুমতি দিলে আমরা দুর্জয়কে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পারব।’
এদিন দুর্জয়ের মা নমিতা দেবী, মামা সুব্রত মণ্ডল দুর্জয়কে ফিরে পাওয়ার আশায় কলকাতার ইলিয়ট রোডে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিশনে গিয়েছেন।
একই কারণে সেই কমিশনেই যাচ্ছিলেন পার্থ সারথী মিত্রও। পথে যেতে যেতে বলেন, জানেন তো, দুর্জয় আশ্রমে থাকবে না সেটা ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আশ্রমের অন্য আবাসিকদেরও মন খারাপ। তবু ভীষণ ভালো লাগছে দুর্জয় তার বাড়িতে ফিরে যাবে এটা ভেবেই।
এদিন চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির দপ্তরে দুর্জয়ের মা নমিতা দেবী বলেন, ‘আমার ছেলেকে আমি ফেরত পাবই।’ আত্মবিশ্বাসে প্রত্যয়ী নমিতা দেবী এদিনও বলেন, ছেলেকে একদিন ফিরে পাব সেই বিশ্বাস নিয়ে দেশে মানত চড়িয়েছি মন্দির, মসজিদ, দরগায়। গোটা চার বছরে দুই চোখের পাতা এক করতে পারিনি শান্তিতে।
স্বামী বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত, তাই স্বামীকে ছাড়াই নিজে ছেলের খোঁজে এতদিন ধরে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন চারদিকে। এর আগেও ছেলের খোঁজে কলকাতায় এসেছেন তিনি। কলকাতার বিভিন্ন হোমেও খুঁজেছেন। কিন্তু খোঁজ পাননি ছেলের। অবশেষে গত বুধবার নমিতা দেবী তাঁর ভাই সুব্রত মণ্ডলের কাছ থেকে দুর্জয়ের কথা জানতে পারেন।
নমিতা দেবীর ভাই সুব্রত মণ্ডল জানান, কয়েক বছর ধরে দুর্জয়কে খুঁজতে সাহায্য করেছেন উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হাওড়ার একটি স্বেছাসেবী সংগঠনের কর্ণধার সঞ্জীব কাঞ্জিলাল। এখন চলছে অপেক্ষার প্রহর গোনা।
চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিশনের কাছে দুর্জয়কে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আবেদনের সব কাজ প্রস্তুত তাদের। এখন কমিশনের অনুমতির অপেক্ষা। কমিশন অনুমতি দিলেই মা নমিতা দেবী ও মামা সুব্রত মণ্ডলের হাত ধরে নিজের দেশ, বাংলাদেশের পথে পা বাড়াবে দুর্জয়। ফিরবে তার আপন জগতে, স্বাভাবিক জীবনে।