৫১ স্থানে নদীর পানি বৃদ্ধি, বন্যার অবনতি
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/08/23/photo-1440334928.jpg)
টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের বিভিন্ন স্থানের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। দেশের ৫১টি স্থানে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি স্থানে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এই তথ্য জানিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের কয়েকটি জেলার কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে।
এদিকে পানির নিচে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, স্কুল-কলেজ। নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বেশ কয়েকটি নদীতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। বন্যায় পরিবার-পরিজন, গবাদি পশু নিয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। কেউ কেউ উঁচু জায়গায় খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যাদুর্গতদের মধ্যে বিশুদ্ধ পানি এবং শুকনো খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। এখনো কোথাও সরকারি বা বেসরকারি ত্রাণসহায়তা পৌঁছায়নি বলে বন্যাদুর্গতরা অভিযোগ করেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বিজ্ঞপ্তিতে আজ জানানো হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তাই কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী ও মুন্সীগঞ্জ জেলার কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট, সুনামগঞ্জ, শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে এবং সাতক্ষীরা জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আরো জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি নয় সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার, রংপুরের বদরগঞ্জ পয়েন্টে যমুনেশ্বরী নদীর পানি ৪৯ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার, কুড়িগ্রামের চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ২২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার দুই সেন্টিমিটার, জামালপুরের বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ২৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনার পানি ৪০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার, সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনার পানি ৩৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার, বাঘাবাড়ী পয়েন্টে আত্রাই নদীর পানি ৫৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৮১ সেন্টিমিটার এবং এলাসিন পয়েন্টে ধলেশ্বরী নদীর পানি ৪০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার নয় সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দিরাই পয়েন্টে পুরাতন সুরমার পানি ১৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশের বিভিন্ন জেলার বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
আতিকুর রহমান সোহাগ, বগুড়া : জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের আটটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে এবং কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মানুষ খোলা আকাশের নিচে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এখানে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকটের পাশাপাশি জ্বালানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে।
অসীম মন্ডল, সিরাজগঞ্জ : বন্যার পানিতে সিরাজগঞ্জের জেলা সদর, কাজীপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলার নিম্নাঞ্চলের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পরিবার পরিজন ও গবাদি পশু নিয়ে অনেকেই পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আবার অনেকেই তাদের বসতবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। অনেকের ফসল ভেসে গেছে। বন্যাদুর্গতদের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি এবং শুকনো খাবারের সংকট। এদিকে কাজীপুর ও চৌহালী উপজেলায় শুরু হয়েছে নদীভাঙন। চরাঞ্চলের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় পাঠদান ব্যাহত হয়ে পড়েছে।
হাসিবুর রহমান হাসিব, কুড়িগ্রাম : বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার ৫৩ ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ। পানিতে তলিয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। বসতভিটা ও সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বানভাসি মানুষজন গবাদি পশু নিয়ে অনেকে পাউবোর বাঁধের রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যাদুর্গতদের অভিযোগ, ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান-সদস্যরা তাঁদের কোনো খোঁজ নিচ্ছে না।
সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউপির চেয়ারম্যান আমির হোসেন জানান, তাঁর ইউনিয়নের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সরকারি বা বেসরকারিভাবে এসব মানুষের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণসহায়তা পাওয়া যায়নি।
জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমীন জানান, বন্যাদুর্গতদের জন্য ৮০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দ্রুত বিতরণ করা হবে। এ ছাড়া তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তালিকা তৈরি হলে আরো ত্রাণসহায়তা চেয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, বন্যার পানিতে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে ৪৫ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমির আমন ক্ষেত।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শওকত আলী সরকার জানান, ‘যেহেতু অতিবৃষ্টির কারণে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে, সেহেতু আশা করছি বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাবে। পানি দ্রুত নেমে গেলে উঁচু স্থানের আমন ক্ষেতের তেমন ক্ষতি হবে না।’
শফিক জামান, জামালপুর : যমুনার পানি বাড়ায় জেলার ইসলামপুর উপজেলার কুলকান্দি, পাথর্শী, বেলগাছা, চিনাডুলী ও সাপধরী এবং দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চুকাইবাড়ি ও চিকাজানি ইউনিয়নের ২৫টি গ্রামের ৩০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়িঘরে পানি ওঠায় অনেকেই উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে হঠাৎ বন্যার কারণে কাজ না থাকায় চরম বিপাকে পড়েছে শ্রমজীবী লোকজন।
ইসলামপুর উপজেলার পাথর্শী ইউপির চেয়ারম্যান হাসমত আলী জানিয়েছেন, আকস্মিক বন্যায় তাঁর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ রোপা আমন পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যা দীর্ঘায়িত হলে এই অঞ্চলের কৃষকরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন।
জামালপুরের জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খান জানিয়েছেন, বন্যার ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের প্রস্তুতি আছে। বন্যাকবলিত এলাকা, দুর্গত মানুষ ও ফসল সম্পর্কে প্রতিবেদন দিতে বন্যাকবলিত ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ইউএনওদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে যথাসাধ্য সহায়তা নিয়ে বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়াবে প্রশাসন।
কাকন রেজা, শেরপুর : শেরপুরের শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলায় পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে পানি নামতে শুরু করায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। গতকাল ভোরে পাহাড়ি ঢলে সোমেশ্বরী নদীর কুল উপচে দুটি উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। এমনকি ভায়াডাঙ্গা ও ধানশাইল বাজারের মতো উঁচু জায়গাগুলোতেও পানি ওঠে। তবে গতকাল বিকেলেই অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গাগুলো থেকে পানি নামতে শুরু করে। আজ রোববার সকালে শ্রীবরদী উপজেলার ভায়াডাঙ্গা বাজার ও ঝিনাইগাতীর ধানশাইল বাজার এলাকা থেকে নেমে গেছে ঢলের পানি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দুটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল এখনো জলামগ্ন রয়েছে।
আসাদুর রহমান জয়, নওগাঁ : নওগাঁর আত্রাই উপজেলার ফুলবাড়ী স্থানে আজ সকালে আত্রাই নদীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ ভেঙে পাঁচটি গ্রামসহ আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ওই উপজেলার পূর্ব মিরাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এলাকার শত শত একর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, হঠাৎ গতকাল বিকেল থেকে উজানের ঢলের পানিতে আত্রাই নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আজ সকাল ৯টার দিকে ফুলবাড়ী গ্রামের বেড়িবাঁধে ফাটল ধরে। মুহূর্তে ফাটল দিয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকলে দুপুর পর্যন্ত প্রায় ৩০০ ফুট বাঁধ ভেঙে আত্রাই উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যায়। এ ছাড়া জেলার নওগাঁ-আত্রাই সড়ক, সুটকিগাছা-বান্দাইখাড়া সড়ক ও কাশিয়াবাড়ী বেড়িবাঁধে নতুন করে ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এলাকাবাসী, পাউবো ও উপজেলা প্রশাসন বালুর বস্তা দিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করছেন।
নওগাঁ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন জানান, বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে মেরামতের কাজ করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে বলে আত্রাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনিরুল ইসলাম পাটোয়ারী জানান।