বাজেট পর্যালোচনা
তেলা মাথায় তেল দেওয়ার বাজেট
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/06/08/photo-1433741731.jpg)
বাজেট মানে আয়-ব্যয়ের হিসাব। ব্যক্তি যেমন আয়-ব্যয়ের হিসাব কষে, তেমনি রাষ্ট্রকেও হিসাব কষতে হয়। প্রতিটি রাষ্ট্রই বছরভিত্তিক এই আয়-ব্যয়ের হিসাব চিন্তা করে। দেশের অর্থমন্ত্রী প্রতিবছরের মতো এবারও হিসাব-নিকাশ জাতীয় সংসদ অথবা জাতীয় সম্প্রচারে প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের বয়স ৪৪ বছর, সে হিসাবে বাজেট হবে ৪৪টি, বাংলাদেশের ৪৪তম বাজেটটি গত বৃহস্পতিবার পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য বাজেট পেশ করেন। এ বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ হচ্ছে দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। হিসাব করে দেখা গেছে, এটাই দেশের সবচেয়ে বড় বাজেট। আবার ঘাটতির মাত্রার দিক দিয়েও এটি সবচেয়ে ঘাটতিবহুল বাজেট। প্রতিবছর বাজেটে ভবিষ্যৎ আয়-ব্যয়ের হিসাব কষে একটি সম্ভাব্য উন্নয়ন মাত্রা নির্ণয় করা হয়। এবার এ ধরনের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ১ শতাংশ। একটি বাজেট আয় ও ব্যয় উভয় ক্ষেত্রেই বহুমুখী। এই অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ আট হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে এক লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা আদায়যোগ্য ধরা হয়েছে। আর এনবিআর-বহির্ভূত সূত্র থেকে কর রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া করবহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। বিদেশি অনুদান আশা করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আয়ের খাত মোটামুটি এ রকম। এবার ব্যয়ের খাতটি দেখা যাক। ব্যয়ের খাতকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—১. উন্নয়ন বাজেট এবং ২. অনুন্নয়ন বাজেট। উন্নয়ন বাজেট হলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার যে টাকা উন্নয়নের জন্য দিয়ে থাকে। আর অনুন্নয়ন বাজেট হলো, সরকার রাষ্ট্র চালানোর জন্য যে খরচাদি করে থাকে, সেই টাকা। উন্নয়ন বাজেটের প্রধান খাতগুলো হলো কৃষি, স্বাস্থ্য, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, শিক্ষা ও প্রবৃদ্ধি। এবার সবচেয়ে ব্যয় বরাদ্দ বেশি ধরা হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে। আর অনুন্নয়ন বাজেটে এবার সবচেয়ে বেশি খরচ হবে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা খাতে। এর পরিমাণ দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা সবাই এ বাজেটকে অতি উচ্চাভিলাষী বলছেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট ব্যবস্থার গতানুগতিক পদ্ধতি অনুসরণ করেই ‘উচ্চ প্রবৃদ্ধি আরোহণ করতে চান’। এ জন্য তিনি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অতীতের ভুল-ত্রুটিগুলো সংশোধন না করে উচ্চ সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়তে চান অর্থমন্ত্রী। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা অনার্থক ব্যয়, অপব্যয়, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক লুটপাটের নিরসন না করেই উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চান বর্তমান অর্থমন্ত্রী। এই বাজেটকে মোটামুটিভাবে তেলে মাথায় তেল দেওয়ার বাজেট বলে উল্লেখ করা যায়। প্রতিবছরে দেখা যায়, ধনিক-বণিক শ্রেণির লোকেরা অর্থনৈতিক সুবিধা পায়, আর গরিব শ্রেণির ওপর করের বোঝা বাড়তেই থাকে। উদাহরণ হিসেবে এই বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা বহুলাংশে সাধারণ মানুষের ওপর বর্তাবে। প্রতিবছর করের বোঝা বেড়েই চলেছে। স্বপ্নপূরণে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ৩০ দশমিক ৬২ শতাংশের অর্থ হচ্ছে, সাধারণ মানুষকে আগামী বছর দিতে হবে অধিক ৪৫ দশমিক ০৭২ কোটি টাকার কর। অর্থমন্ত্রী অনায়াসেই বলছেন, এ কর আদায় করা সম্ভব। অথচ অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রাজস্ব আদায় একরকম অসম্ভব। অর্থমন্ত্রী সাধারণ মানুষের করের বোঝা আরো বাড়ানোর জন্য নতুন ক্ষেত্রের সন্ধান করছেন। এত দিন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর কোনো কর আরোপের ব্যবস্থা ছিল না। এবারের বাজেট প্রস্তাবনায় ফুটপাতের হকার থেকে সব দোকানপাটে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বাড়াবে। একই সঙ্গে নব্য ধনিক শ্রেণিকে সহায়তা দেওয়ার প্রয়াস লক্ষণীয়। বিনিয়োগ বাড়াতে অর্থনৈতিক অঞ্চল হাইটেক পার্কের ডেভেলপার এবং এসব অঞ্চল বা পার্কের বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদি বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। গাড়িওয়ালাদের গাড়ি কেনার সুবিধার জন্য অটোমোবাইল খাতে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাবও করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংযোগ শিল্প হিসেবে নতুন প্রতিষ্ঠিত গাড়ির চাকা উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে কর অবকাশ সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ প্রস্তুতকারী শিল্পগুলো এখন যেসব শুল্ককর অব্যাহতির সুবিধা পাচ্ছে, আগামী অর্থবছরেও তা অব্যাহত থাকবে। ওষুধশিল্পকে গর্ভের শিল্প উল্লেখ করে আগামী বাজেটে এর কাঁচামাল ও উপকরণে শুল্ক রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। শুল্ককর অব্যাহতির সুবিধা অব্যাহত থাকছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রতিষ্ঠানগুলোতেও কর অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এই বাজেটে সরকারি কর্মকর্তাদের নতুন বেতন বৃদ্ধিকে শুভংকরের ফাঁকি বলা যায়। এমনিতেই বেতন বৃদ্ধি ঘটলেও ভাতা বৃদ্ধি ঘটছে না। তদুপরি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতনের পাশাপাশি উৎসব করসহ অন্যান্য ভাতার ওপরও কর আরোপের চিন্তা করা হচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপরও কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
এ বাজেটকে অনেকেই ঘাটতি বাজেট বলে অভিহিত করেছেন। ৮০ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা ঘাটতি দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, বিদেশি, দেশীয় ব্যাংক ও অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নিয়ে ঘাটতি মেটানো হবে। এ কারণে এবারের বাজেটকে অনেকে ঋণনির্ভর বাজেট বলেছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার বাজেট ঘাটতি ঋণ পূরণে বেশি মাত্রায় ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণ পাওয়া কঠিন হবে।
এ সবকিছু সত্ত্বেও আশাবাদ নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, ‘শত প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি, বৈরিতা এবং এক ধরনের নির্বোধ দেশশত্রুতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সব প্রতিবন্ধকতা তুচ্ছ করে আমাদের কর্মঠ, কষ্টসহিষ্ণু, সাহসী ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা সাধারণ জনগণ তাঁদের শ্রম, মেধা, প্রজ্ঞা ও আন্তরিকতা দিয়ে অগ্রগতির এ চাকা সচল রেখেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের অগ্রযাত্রা থাকবে নিয়ত সংচরণশীল। আমি বরাবরই এ দেশের অপূরণীয় সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী। আবারো পুনরাবৃত্তি করব যে, আমি ‘অশোধনীয় আশাবাদী’, আমরাও অর্থমন্ত্রীর মতে আশাবাদী হতে চাই। তবে সাধারণ মানুষের উপলব্ধি বদলায়নি এতটুকুও, ‘বাজেট বাজেট মরার বাজেট/বাজেট আলুর দম/বড়র পাতে পড়ল বেশি/ছোটর পাতে কম।
ড. আবদুল লতিফ মাসুম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়