ডাচ সুলতানার ‘মা-ভাইয়েরা’ থাকেন সৌদি আরবে
দীর্ঘ ৩৭ বছর পর স্বজনের খোঁজে চট্টগ্রামে আসা নেদারল্যান্ডসে (ডাচ) বেড়ে ওঠা সুলতানা ভ্যান দার লেস্তকে নিজের মেয়ে বলে দাবি করেছেন সৌদি আরবপ্রবাসী এক নারী।
নেদারল্যান্ডস থেকে চট্টগ্রামের দোহাজারীতে গিয়ে নিজের পরিবারকে খুঁজছেন এক নারী—গণমাধ্যমে এই খবর ও ছবি দেখে সুলতানাকে নিজের বলে শনাক্ত করেন সৌদিপ্রবাসী গুলবাহার। গতকাল রোববার সৌদি আরবের স্থানীয় সময় রাত ৩টায় এনটিভির মক্কা প্রতিনিধিকে বাড়িতে ডেকে এ কথা জানান তিনি। এ সময় গুলবাহারের সঙ্গে ছিলেন তাঁর পাঁচ ছেলে।
গুলবাহার ও তাঁর ছেলেরা জানান, চট্টগ্রামের দোহাজারী রেলস্টেশন এলাকায় বাস করতেন তাঁরা। গুলবাহারের স্বামীর নাম চান মিয়া। এই দম্পতির মোট পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে ছিল। এদের মধ্যে ছোট মেয়ের নাম ছিল শবে মেরাজ। তবে চান মিয়া আদর করে মেয়েকে ডাকতেন পুতুনী। দিনের বেশির ভাগ সময় পুতুনী রেলস্টেশন এলাকায় খেলাধুলা করত। ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁদের দোহাজারীর বাড়ির এলাকা থেকে হারিয়ে যায় সে। সে সময় তার বয়স ছিল সাত/আট বছর।
এই পরিবারের হারিয়ে যাওয়া মেয়ে পুতুনীই নেদারল্যান্ডস থেকে বাংলাদেশে স্বজনদের খোঁজে আসা সুলতানা বলে দাবি করছেন গুলবাহার। এমনকি ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে এর সত্যতা নিশ্চিত করার দাবিও জানিয়েছেন গুলবাহারের ছেলেরা। পুতুনীর বাঁ হাতে টিকার দাগ আছে বলেও জানান তাঁরা। পরিবারের সদস্যরা জানান, বোন হারিয়ে যাওয়ার দুই বছর পর সৌদি আরবে চলে আসে পুরো পরিবার। এর পর থেকে পবিত্র কাবা শরিফসহ বিভিন্ন স্থানে পুতুনীকে খুঁজে পেতে প্রার্থনা করেছেন তাঁরা।
সৌদিপ্রবাসী গুলবাহারের ছেলে সুলতান এনটিভিকে বলেন, তাঁদের ওই ছোট বোনের নাম ছিল শবে মেরাজ। আদর করে তাঁদের বাবা ডাকতেন পুতুনী। সেই থেকে সবাই পুতুনী নামেই ডাকত।
তবে নেদারল্যান্ডসের ওই নারী নিজের নাম সুলতানা বলছেন—সে বিষয়ে জানতে চাইলে সুলতানার এক ভাই ও মা বলেন, তাঁদের হারিয়ে যাওয়া সদস্যের নিজের নাম বদলে বা মিথ্যা নাম বলার অভ্যাস ছিল। ছোটবেলায় তাকে নিজের নাম জিজ্ঞাসা করা হলে সে একেকবার একেক নাম বলত। এ ছাড়া তার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ারও অভ্যাস ছিল। ছোটবেলায় দুবার তাকে বিভিন্ন স্থান থেকে খুঁজে আনতে হয়। এবং সে সময়ও সে নিজেকে কখনো সখিনা, পলানা ইত্যাদি নামে পরিচয় দিত। এ ছাড়া ছোট থেকেই সে বেশ মনভোলা। ভাই সুলতানের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি খেলাধুলা করতেন সুলতানা। সম্ভবত সে কারণেই সবার কাছে নিজের নাম সুলতানা পরিচয় দিচ্ছেন বলে ধারণা করছেন সুলতান। এ ছাড়া পুতুনী একেক সময় একেকজনকে নিজের ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচয় দিত বলেও জানান সুলতান। সম্ভবত সে কারণেই সে নিজের নামসহ অন্য তথ্য ভুল দিচ্ছে বলে ধারণা করছেন তিনি।
গুলবাহারে ছেলেরা জানান, আল্লাহর রহমতে এখন তাঁদের গাড়ি, বাড়ি, টাকা-পয়সা সব আছে। তাঁরা এখন শুধু তাঁদের আদরের ছোট বোনকে চান। বোন হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে আল্লাহর কাছে শুধু বোনকে খুঁজে পেতে প্রার্থনা করেছেন তাঁরা।
স্বজনদের খোঁজ পেতে গত ১ ফেব্রুয়ারি নেদারল্যান্ডস থেকে স্বামী-সন্তানসহ বাংলাদেশে আসেন সুলতানা। পরিবারের সদস্যদের খুঁজে পেতে ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। সেখানে তিনি জানান, জন্মের পর তাঁর মা-বাবা মারা যান। দাদা-দাদির কাছে চার বছর পর্যন্ত বেড়ে ওঠেন। চার বছর বয়সে মুসলেম আলী খান নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে দাদি রাহিমা খাতুন তাকে তুলে দেন ডাচ দম্পতি কেয়া ও ক্রিসের কাছে। এর পর সুলতানা পরিচয়ে বেড়ে ওঠেন তিনি। সফলভাবে পড়ালেখা শেষ করে নেদারল্যান্ডসের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। পরে বিয়ে করেন ইউরি জ্যাকভকে। জ্যাকভ একজন ডিজাইনার। এখন আবেদ আবিলা জ্যাকব নামের এক সন্তান রয়েছে তাঁদের।
সুলতানার কাছে আছে একটি প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের হলফনামা। সেখানে তাঁর বাবা ও মায়ের মৃত্যুর কথা বলা আছে। এখন তাঁর দাদা-দাদি বেঁচে না থাকলেও ছোট ভাই বা বোন এখনো বেঁচে আছে, এমন আশা তাঁর। সে জন্য পরিবারের সদস্যদের খুঁজতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের দোহাজারীর অলিগলি ঘুরেছেন তিনি। সুলতানার কাছে থাকা হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, সুলতানার জন্ম ১৯৭৫ সালের ৮ জানুয়ারি, চট্টগ্রামে পটিয়া উপজেলার দোহাজারীতে। তাঁর বাবা-মা মারা যাওয়ার পর ভরণপোষণে ব্যর্থ হয়ে দাদি রহিমা খাতুন ১৯৭৯ সালে সুলতানাকে নেদারল্যান্ডস ইন্টার কান্ট্রি চাইল্ড ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের কাছে দত্তক দেওয়ার জন্য হস্তান্তর করেন। পরে সেখান থেকে নেদারল্যান্ডসের কেয়া ও ক্রিস দম্পতির কাছে দত্তক দেওয়া হয় সুলতানাকে।