প্রবাসীর মনে দূর্গোৎসব

দুর্গা পূজা চলে এলো। দেশে থাকতে গ্রামে পূজার আয়োজনের জন্য ছোটবড় সবাই মিলে কয়েকটি দলে ভাগ হতাম। কেউ পূজার মণ্ডপ তৈরি, কেউ ঢাকঢোলসহ বাদ্যযন্ত্র, কেউ এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় ভক্তদের পূজার নিমন্ত্রণের সাথে দক্ষিণা সংগ্রহ করা, আবার কেউ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, কেউ আপ্যায়নের ইত্যাদির মাঙ্গলিক কার্যে স্বাচ্ছন্দ্যে দায়িত্ব নিত।পূজার দীর্ঘ এক মাস আগে থেকে মণ্ডপের কাজ এবং মায়ের প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হতো।
বিশ্বকর্মার মতো নান্দনিক কারুকার্যে কারিগর দিনদিন মাটির মূর্তিকে দেবীর মায়ের অলংকারে সজ্জিত করা হতো । পূজার জন্য নতুন নতুন পোশাক, তারাবাজি, সিকবাজিসহ অনেক কিছু সংগ্রহ করে রাখতাম। পরিবারের ছোট বলে আদর করে সবাই পূজার সম্মানী দিত।যা এখন হাজার চেষ্টা করেও সামনে আনতে পাই না । এখন শুধু স্মৃতি হিসেবেই আছে।
মহালয়া থেকেই শুরু করে ষষ্ঠীর দিন মণ্ডপে মায়ের প্রতিমার প্রাণ সঞ্চার, সন্ধ্যা আরতি, ভোগ, ফুল তোলাসহ বিভিন্ন কার্যাদি এগিয়ে চলত। সপ্তমীতে এক মণ্ডপ থেকে অন্য মণ্ডপে ঘোরাঘুরি, অষ্টমীতে আমাদের হরি মন্দিরে আয়োজনে থাকতে হবে, সবার কঠোর প্রস্তুতি মণ্ডপে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক ভক্তের সমাগম।
সন্ধ্যা হলে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব বন্ধুদের সাথে নিয়ে ঢাক ঢোলের বাজনার আরতি চলত। একে অপরের হাত ধরে, কাঁধে কাঁধ রেখে মনের আনন্দে ফুটে উঠে সংস্কৃতির এক মিলনমেলা হতো। সাম্প্রদায়িকতা ভুলে যেন দুর্গোৎসব হয়ে উঠত সবার প্রাণের উৎসব। আনসার বাহিনী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে পূজা চলাকালীন শৃঙ্খলারক্ষক হিসেবে পাহারা দেয়। প্রতিদিন বিকেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ভক্তিমূলক সঙ্গীতে ভরে উঠত মন্দির প্রাঙ্গণ। নবমীর দিন হলো পূজার শেষরাত্রি । তাই আনন্দের মাত্রাটি আরেকটু বেড়ে যায় । এক বছর পর মায়ের পূজা ফিরে আসবে। একের পর এক বাদ্যের বাজনা বাজে আর ঐদিন সবাই গভীররাত্রি পর্যন্ত সন্ধ্যারতি হয়।বিজয়া দশমীর দিন ভোরে শুরু হয় নগর কীর্তন। প্রতি ঘরে ঘরে শান্তির বার্তা পৌছে দিয়ে জড়ানো হয় বুকের সাথে বুকের মধুর আলিঙ্গন। এরপর আদ্যশক্তি মহাময়ার বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পূজার সমাপ্তি।
কালের পর কাল থেকে চলে আসা সনাতনী এই পৌরাণিক মাঙ্গলিক কার্যাদি মহিষাসুরমোর্দিনী আদ্যাশক্তি মহামায়ার দেবীমাহাত্ম্য থেকে ভিতরের বিবেকের কাছে পৌঁছে দেই মনের অসুর দমনের কথা।এ যে শান্তিকামী মানুষের কাছে অসুররূপী মানুষের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মাটির বানানো মূর্তি হয়ে প্রতি হৃদয়ে পৌছে দেয় শান্তিরবার্তা। এখনো গ্রামে প্রতি বছরের ন্যায় পূজার আয়োজন চলছে কিন্তু দূর বহুদূর।
সিঙ্গাপুরে আসার পর থেকে যান্ত্রিকতার কাছে সময় চলে। এসব প্রাণবন্ত মাঙ্গলিক কাজ, আনন্দের কাজ, উৎসবমুখর সময়গুলো কেমন জানি অনেক দূরে। ইচ্ছে হলেও কাছে পাই না, মধুর স্মৃতিগুলো ভেসে উঠে মনের ক্যানভাসে।এখানে ও পূজা হয় সুন্দর সুশৃঙ্খলভাবে কিন্তু ভালোবাসর কাছে এসব সান্ত্বনা দেয় প্রবাসের বুকে। মন পড়ে থাকে নাড়িরটানে, মণ্ডপ তৈরিতে, খুব ভোরে ফুল তুলতে, পকেটে মণ্ডপের জিলাপি মুড়ি রাখতে, নৈবদ্য তৈরি করতে, মা বোনদের সাথে পুঁথিপাঠ করতে, তারাবাজি জ্বালাতে, ঢাকঢোল বাজাতে, মৈত্রীর বন্ধন খুঁজতে।