প্রবাসীদের ঈদ ভাবনা : স্মৃতি, চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

এক মাস সিয়াম সাধনার পর উৎসবের বার্তা বয়ে আনে পবিত্র ঈদুল ফিতর। শাওয়ালের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হবে নানা আয়োজন। মুসলিমদের সবচেয়ে বড় এই উৎসবকে ঘিরে এখন থেকেই পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন অনেকে। ঘুরাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোসহ নানাভাবে ঈদ উদ্যাপন করে থাকি আমরা। তবে জন্মভূমি ছেড়ে দূর প্রবাসে যারা আছেন, তাদের উদযাপনে থাকে ভিন্নতা।
প্রবাস জীবনের ঈদ ভাবনা ও অভিজ্ঞতা এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মো. হাফিজুর রহমান, চীনের ত্বহা, ডেনমার্কের দম্পতি নোভানা ও নিশান এবং ইংল্যান্ডের হুমায়রা নাজিব নদী।
‘তুষারের স্তূপে ঈদ ভাবনা’
মো. হাফিজুর রহমান
ওরোনো, মেইন, যুক্তরাষ্ট্র
ঈদের দু-দিন আগে যখন আমি প্রবাসে বসে লিখছি, বাইরে তখনও তুষারের স্তূপ। অন্যদিকে বাংলাদেশে চমৎকার আবহাওয়া, বসন্তের শেষে ঈদের আমেজ। ছোটবেলা থেকেই ঈদের দিনটি আমার কাছে অন্য রকম আনন্দের।
ফজরের আজানের পর আব্বু আমাদের ছোট ভাই-বোনদের ঘুম থেকে ডেকে দিতেন। এরপর একে একে গোসল সেরে ফজরের নামাজ আদায় করে নতুন জামা পরতাম। আম্মু ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নানারকম সুস্বাদু খাবারের সুবাসে ঘরটা ভরিয়ে দিতেন। তার হাতে তৈরি খাবার আমাদের মুখে হাসি এনে দিত।
এরপর সবাই মিলে ঈদগাহে নামাজ পড়ে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম। এছাড়াও বড়দের কাছ থেকে ঈদ সালামি নিয়ে ছোটদের মাঝে ভাগ করে দেওয়ার আনন্দই ছিল এক অনন্য অনুভূতি।
তবে আজ সেই অনন্য মুহূর্তগুলো শুধুই স্মৃতির পাতায়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেইনে পিএইচডি করছি। পরপর পাঁচটি ঈদ পরিবার থেকে দূরে কাটাতে হচ্ছে। এখানে আসার আগে কখনো পরিবার ছাড়া ঈদ করা হয়নি। এখানকার প্রতিটি ঈদ আমাকে পরিবার ও পরিজনের স্নেহ-মমতা এবং ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দেয়। এখন ঈদের আনন্দ পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি হয় শুধু ভিডিও কলের মাধ্যমে।
এখানে ঈদের জন্য কোনো ছুটি নেই। তবে দূর প্রবাসে একমাত্র সান্ত্বনা এখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটি। কমিউনিটির সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করে মনে হয়, বুকের মাঝে এক টুকরো বাংলাদেশ নিয়ে বেড়াচ্ছি। এখন তারাই হয়ে উঠেছে এই প্রবাসের পরিবার৷ পরিশেষে একটাই চাওয়া—সবার ঈদ ভালো কাটুক, আনন্দে কাটুক। ঈদ মোবারক।
‘ঈদের আনন্দ কমে গেছে’
ত্বহা
কলেজ অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, নানজিং টেক ইউনিভার্সিটি, চীন
ঈদ একটি বিশেষ দিন, যা আমাদের ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত বিশেষ অনুভূতির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। কিন্তু একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়—‘যখন মনে হবে ঈদের আনন্দ কমে গেছে, তখন বুঝে নেবেন আপনি বড় হয়ে গেছেন।’ এবার সত্যিই মনে হচ্ছে, আমি বড় হয়ে গেছি।
এবার ঈদটা পুরোপুরি ভিন্ন কারণ আমি দেশের বাইরে। গত বছর ঈদ কেটেছে পরিবারের সঙ্গে ঘরোয়া আনন্দ, কেনাকাটা, ঈদের নামাজ, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, ছোটদের সালামি দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে। আর এবার চীনে ঈদের দিনটি একেবারেই আলাদা হতে চলেছে। দিন-রাতের কঠিন কাজ, ক্লাস, ল্যাবের গবেষণা, ডেডলাইন—সব মিলিয়ে ঈদের আগের আমেজ যেন হারিয়ে ফেলেছি।
২৯টি রোজা হলে হয়ত ঈদে একটু আনন্দ পাবো, কিন্তু ৩০টি হলে ঈদের পরদিনই আবার ক্লাস। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। কিছু সহপাঠী মিলে ঠিক করলাম, শিক্ষকদের কাছে ঈদের দিন ছুটির জন্য আবেদন করব। কেউ কেউ সমর্থন দিলেন, কেউ রাজি হলেন না। তবে শেষ পর্যন্ত যদি ছুটি মেলে, তাহলে অন্তত ঈদের দিনটা একটু স্বস্তির সঙ্গে কাটাতে পারব।
যত দূরেই থাকি, ঈদের আনন্দ অনুভব করা যায় নিজের বিশ্বাস ও চেষ্টার মাধ্যমে।
‘ঈদে পরিচিত সবাই আড্ডা দিব’
নোভানা নাসির ও রাব্বী নিশান (দম্পতি)
রিসকভ (আরহুস), ডেনমার্ক
ঈদের জন্য ছুটি নিয়েছি। ঈদের দিন সকালে সেমাই দিয়ে শুরু করব, তারপর দেশি খাবার খেয়ে সাজগোজ করে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাব। রাতে পরিচিত কারও বাসায় সবাই মিলে আড্ডা দেব।
এক বছর হলো আমরা ডেনমার্কে এসেছি। পরিবার ছাড়া ঈদ আসলে ঈদের মতো লাগে না। তবুও এখানকার নতুন বন্ধু-পরিবার নিয়ে দিনটি ভালোভাবে কাটানোর চেষ্টা করি।
‘প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গেই ঈদ কাটবে’
হুমায়রা নাজিব নদী
এসেক্স, ইংল্যান্ড
আমি ১৫ বছর ধরে ইংল্যান্ডে আছি। এখানে মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারে (M&S) কাজ করি। ঈদের দিন কোথাও যাই না, বাসাতেই থাকতে পছন্দ করি। সবার জন্য বাসায় দাওয়াতের আয়োজন করি। এখানে ছুটি পাওয়ার নিয়ম হলো—এক মাস আগে জানাতে হয় যে আমি ছুটি চাই। তাই ঈদের দিনটা আগেই নিশ্চিত করে নিতে হয়।
ঈদের দিন সকালে বিভিন্ন ধরনের সেমাই আর দেশীয় খাবার রান্না করে মেহমানদের আপ্যায়ন করি। আমার বাচ্চাদের চেষ্টা করি ঈদ সম্পর্কে সচেতন করতে। এখানে যেহেতু ক্রিসমাস জাঁকজমকভাবে উদযাপিত হয়, তাই ঈদের তেমন পরিবেশ থাকে না। তাই সবাই লন্ডনের গ্রিন স্ট্রিটে যাই, যেখানে বড় মেহেদি ফেস্টিভ্যাল হয়। সেখানে দেশ-বিদেশের অনেক মানুষ জড়ো হয়, প্রচুর ভিড় থাকে। এবার প্রচণ্ড ঠান্ডা, জানি না বাচ্চাদের চাঁদ রাতে মেহেদি উৎসবে নিয়ে যেতে পারবো কিনা। তবে আমাদের প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গেই ঈদ কাটবে ইনশাআল্লাহ।