মোহাম্মদ আলীর কাছে বাংলাদেশ ছিল স্বর্গের মতো

মোহাম্মদ আলীর বক্সার হওয়ার গল্পটা বেশ চমকপ্রদ। ১৯৫৪ সালে একবার তার সাইকেল চুরি যায়। পুলিশের হাতে চোর ধরা পড়ার পর ইন্সপেক্টর মার্টিনকে অদ্ভুত এক অনুরোধ করে ১২ বছর বয়সী আলী। সে জানায়, চোরকে পেটানোর ইচ্ছার কথা। তখন মার্টিন জানান, এর জন্য তোমাকে লড়াই করা জানতে হবে। পুলিশের পাশাপাশি মার্টিনের আরও একটি পরিচয় ছিল। বক্সিং কোচ! ব্যস, সে-ই শুরু। মার্টিনের অধীনেই বক্সিংয়ে হাতেখড়ি হয় আলীর।
জনতা ও বার্তা সংস্থা বিবিসির রায়ে ১৯৯৯ সালে সর্বকালের সেরা অ্যাথলেট নির্বাচিত হন বক্সার মোহাম্মদ আলী। তিনি নিছকই একজন ক্রীড়াবিদ ছিলেন না। মোহাম্মদ আলী একটা পরিবর্তনের নাম। একটা বিপ্লবের নাম। ইতিহাসের রঙিন খামে মোড়ানো অবিস্মরণীয় এক অধ্যায় তিনি।
১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি রাজ্যের লুইসভিলে জন্মগ্রহণ করেন ‘ক্যাসিয়াস মার্কেলাস ক্লে জুনিয়র।’ দাসপ্রথা বিরোধী রিপাবলিক রাজনৈতিক নেতা ক্যাসিয়াস ক্লে’র নামানুসারে এই নাম রাখা হয়। ১৯৬৪ সালে তিনি ইসলামী সংগঠন ‘নেশন্স অব ইসলাম’-এ যোগ দেন তিনি। নাম বদলে রাখেন মোহাম্মদ আলী। ১৯৭৫ সালে পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম কেন গ্রহণ করেছিলেন?
মোহাম্মদ আলীর ব্যাখ্যা ছিল এমন— ‘আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি, কারণ অন্য কোনো ধর্মে মানুষের মধ্যে এতো ভালোবাসা দেখিনি। কোলাকুলি করা, সালাম বিনিময়, এক সঙ্গে প্রার্থনা করার পাশাপাশি ভাই-বোন বাবা-মা, পারিবারিক শিক্ষা, মূল্যবোধ ইসলামেই সবচেয়ে শক্ত। তাই ইসলাম ধর্মকে বেছে নিয়েছি।’
আলী তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে মোট ৬১ ম্যাচে খেলেন। জয় ৫৬, পরাজয় ৫। ৫৬ জয়ের ৩৭ টি নকআউট! ২৯ অক্টোবর ১৯৬০ সালে পেশাদার বক্সিংয়ে প্রথম জয় পান আলী। তারপর ১৯৬৩ পর্যন্ত খেলা ১৯ ম্যাচের সবকটিতে জেতেন, যার ১৫ টিতেই নকড আউড হয় প্রতিপক্ষ।
১৯৬০ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে স্বর্ণ জেতেন আলী। ১৯৬৫ সালে প্রথম চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। যা তাকে এনে দিয়েছিল তৎকালীন সর্বকনিষ্ঠ চ্যাম্পিয়নের খেতাব।
আমেরিকান আর্মির পক্ষ থেকে দেয়া ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ প্রত্যাখান করায় ১৯৬৭ সালে বক্সিং থেকে ৩ বছর নিষিদ্ধ হন এবং ৫ বছরের জন্য জেল হয় আলীর। অবশ্য ১৯৭০ সালে চার বছর পরই মুক্তি পেয়ে খেলায় ফেরেন।
১৯৭১ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হয় জো ফ্রেজিয়ার বনাম মোহাম্মদ আলীর ম্যাচ। শতাব্দীর সেরা ম্যাচ হিসেবে স্বীকৃত সেই ম্যাচে ফ্রেজিয়ারের কাছে পরাজিত হন আলী। ফ্রেজিয়ারের বিপক্ষে সেটি ছিল তার প্রথম ম্যাচ। ১৯৮১ সালে অবসর নেওয়া মোহাম্মদ আলী ৩টি হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ, একটি অলিম্পিক স্বর্ণপদকসহ মোট ৩১টি মেজর ট্রফি জিতেন।
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আসেন সর্বকালের সেরা এই অ্যাথলেট। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করেন। বাংলাদেশে বসে তিনি বলেন, ‘যদি স্বর্গ দেখতে চাও, তাহলে বাংলাদেশে এসো। বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় বাড়ি।’
জীবনের বিভিন্ন সময়ে অভিনয় করেছেন বেশকিছু ফিল্ম, ডকুমেন্টারিতে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বাক হোয়াইট (১৯৬৯), ব্ল্যাক রোডিও (১৯৭২), দি গ্রেটেস্ট (১৯৭৫, আলীর আত্মজীবনী), ফ্রিডম রোড (১৯৭৮)।
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে জীবনভর সোচ্চার থেকেছেন আলী। তার আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে, একটি রেস্টুরেন্টে কৃষ্ণাঙ্গদের খাবার পরিবেশনে সেখানকার ওয়েটাররা অসম্মতি জানালে রাগে ক্ষোভে নিজের একমাত্র অলিম্পিক পদকটি ওহিয়ো নদীতে ফেলে দেন তিনি!
২০১৪ সাল থেকে আলীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। নিয়মিতই যাতায়াত শুরু হয় হাসপাতালে। ২০১৬ ৩ জুন ‘সেফটিক শকের’ ফলে ৭৪ বয়সে মৃত্যু হয় এই কিংবদন্তি। ইতি ঘটে আলোচিত ও রঙিন এক অধ্যায়ের।