আদালত কক্ষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যায়বিচারের বিপ্লব নাকি মৌলিক অধিকারের ঝুঁকি?

আদালত কক্ষ, যা দীর্ঘকাল ধরে মানুষের বিচার ও পেশাদার দক্ষতার ওপর নির্ভর করে এসেছে, সেখানে এখন একটি বড় প্রযুক্তিগত প্রশ্ন উঠেছে— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কি একজন বিশেষজ্ঞ সাক্ষীর ভূমিকা নিতে পারে? আইনি ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা মনে করে, এআই প্রমাণ প্রক্রিয়াকরণ ও উপস্থাপনের পদ্ধতি বদলে দিলেও এটি মানুষের সাক্ষ্য প্রতিস্থাপন করতে পারবে কিনা তা নিয়ে গুরুতর দ্বিধা রয়েছে।
মার্শাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রানায়াভা (যিনি একই সঙ্গে একজন চিকিৎসক ও আইনজীবী) মনে করেন, ফরেনসিক মেডিসিনের ক্ষেত্রে এআই যে পরিবর্তন এনেছে তা ‘বিপ্লবী’। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, কীভাবে পূর্বে বিশেষজ্ঞদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে হাতে হাতে চিকিৎসা রেকর্ড পরীক্ষা করতে হতো।
রানায়াভা বলেন, ‘আজ, এআই শত শত পৃষ্ঠার পিডিএফ ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ করতে পারে ও কয়েক মিনিটের মধ্যে সেগুলোর সারসংক্ষেপ তৈরি করতে পারে, যা আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগত।’ তাঁর মতে, এআই ভবিষ্যৎ নয়, এটি এখান, এবং এটি ইতিমধ্যেই একজন স্বাধীন চিকিৎসা পরীক্ষকের করা একাধিক জিনিস পরিবর্তন করেছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, এআই একজন বিশেষজ্ঞ সাক্ষীর জন্য পরিবেশ পরিবর্তন করেছে ও এটি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
স্বচ্ছতা ও গোপনীয়তার চ্যালেঞ্জ
যদিও এআই সুবিধা এনেছে, তবুও এটি গোপনীয়তা ও নির্ভরযোগ্যতার ক্ষেত্রে নতুন ঝুঁকি তৈরি করেছে। রানায়াভা সতর্ক করে বলেন, এইচআইপিপিএ (মার্কিন স্বাস্থ্য আইন) ও ইউরোপের গোপনীয়তা আইনের মতো নিয়মগুলো সংবেদনশীল চিকিৎসা তথ্য সুরক্ষিত রাখার জন্য পেশাদারদের ওপর কঠোর দায়িত্ব আরোপ করে।
রানায়াভা বিশেষভাবে জেনারেটিভ এআই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, অন্য চ্যালেঞ্জ হল এআই কখনো কখনো আপনাকে খুশি করার চেষ্টা করতে পারে ও এমন কিছু জিনিসকে বিভ্রান্ত করতে পারে যা বিদ্যমান নেই। তিনি বলেন, এর জন্য মানুষের তদারকি অপরিহার্য।
এআই : সাক্ষী নয়, একটি শক্তিশালী হাতিয়ার
নিউ ইয়র্কের জন জে কলেজ অফ ক্রিমিনাল জাস্টিসের অধ্যাপক আলী কোকাক এআই-কে সাক্ষীর পরিবর্তে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে দেখেন। তিনি বলেন, আদালতগুলো মুখের স্বীকৃতি, ডিএনএ মিশ্রণ বিশ্লেষণ, বন্দুকের গুলি শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (শটস্পটার) ও ভবিষ্যদ্বাণীমূলক পুলিশিংয়ের মতো কাজের জন্য এআই ব্যবহার করে। এই ফলাফলগুলেঅকে সাধারণত ‘অ-প্রমাণমূলক তথ্য’ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
তবে কোকাক জোর দিয়ে বলেন, এআই এখনো একজন বিশেষজ্ঞ সাক্ষী হিসেবে কাজ করতে পারে না। এর প্রধান কারণ হলো, একজন বিশেষজ্ঞ সাক্ষীকে তাদের যুক্তি, পদ্ধতি ও সিদ্ধান্তগুলো স্বচ্ছভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়, যা এআই সিস্টেম, বিশেষ করে মেশিন লার্নিং ব্যবহারকারীরা, প্রায়শই পারে না। এগুলো প্রায়শই ‘ব্ল্যাক বক্স’ হিসাবে কাজ করে— ফলাফল সঠিক হলেও তারা নির্ভরযোগ্যতা ও পুনরুৎপাদনযোগ্যতার আইনি মান পূরণের জন্য তাদের যুক্তি ব্যাখ্যা করতে পারে না।
সাম্প্রতিক আদালতের মামলাগুলোও দেখায় যে এআই প্রমাণগুলোকে ভিন্নভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যেমন, কমনওয়েলথ বনাম উইডেন মামলায় শটস্পটার ডেটাকে মেশিন-জেনারেটেড ডেটা হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়, যার জন্য জেরা করার প্রয়োজন হয়নি।

ভবিষ্যতে যদি জুরি ও বিচারকরা এআই আউটপুটগুলোর ওপর খুব বেশি নির্ভর করতে শুরু করেন, তবে মানব বিশেষজ্ঞরা এআই অনুসন্ধানের দোভাষী বা যাচাইকারী হিসাবে বেশি কাজ করবেন, দক্ষতার প্রাথমিক উৎস হিসেবে নয়—এমনটা মনে করেন কোকাক।
রানায়াভা বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর জোর দিয়ে সতর্ক করে বলেন, বিশেষজ্ঞ সাক্ষীদের অবশ্যই সত্যের পক্ষে থাকতে হবে, কোনো পক্ষের সমর্থক হওয়া চলবে না। তিনি আরও বলেন, এআই-এর সঙ্গে চ্যালেঞ্জ হল এটি কখনো কখনো ‘চেরি-বাছাই’ করে আপনার পছন্দসই উত্তর দিতে পারে, যা বিচার ব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক।
এআই-কে বৃহত্তর ভূমিকা পালন করার জন্য, কোকাক মনে করেন স্বচ্ছতা ও আইনি সংস্কার উভয়ই জরুরি। প্রযুক্তিগতভাবে এআই সিস্টেমগুলেঅকে আরও স্বচ্ছ ও ব্যাখ্যাযোগ্য হতে হবে যাতে তাদের যুক্তি আদালতে যাচাই করা যায়। আইনত, বিবাদীদের এআই সিস্টেমের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ও পরীক্ষা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য সংস্কার প্রয়োজন, ঠিক যেমন তারা একজন মানব বিশেষজ্ঞকে জেরা করে।