ত্রিপুরা ডায়েরি
ভাস্কর্যের পাহাড় ঊনকোটির পথে

করোনাভাইরাসের এই বৈশ্বিক মহামারিতে সারা পৃথিবী থমকে গেছে প্রায়। বানচাল হয়ে গেছে ভ্রমণপিপাসু মানুষের ঘুরে বেড়ানোর সব পরিকল্পনা। তবুও মানুষ বাঁচে আশায়। স্বপ্ন দেখি, পৃথিবী সুস্থ হলেই আবার বেরিয়ে পড়ব। এই আবদ্ধ ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে ভ্রমণ স্মৃতিচারণা, ছবি দেখা আর গল্পেই মনকে মানিয়ে নেওয়া। করোনা দেশে বিস্তারের ঠিক কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম সেভেন সিস্টার্সের ক্ষুদ্রতম রাজ্য ত্রিপুরায়। দেশের বাইরে নিকটবর্তী গন্তব্য হিসেবে ত্রিপুরা হতে পারে অন্যতম পছন্দ, যা হয়তো অনেকেই জানেন না। করোনা-পরবর্তী সময়ে চাইলেই অল্প সময়ে ও অল্প খরচে ঘুরে আসতে পারবেন ত্রিপুরা থেকে। পাঠকের জন্য আজ স্মৃতির ডায়েরি থেকে থাকল ত্রিপুরা রাজ্যের ঊনকোটি ভ্রমণের গল্প। আশা করি, এই ঘরবন্দি সময়ে তা কিছুটা হলেও মনের খোরাক মেটাবে।
বহুদিনের পরিকল্পনা হলেও নানা বাধায় আর সময় হয়ে উঠছিল না। অবশেষে ছোটখাটো ছুটির ব্যবস্থা করে অবশেষে ত্রিপুরায় পৌঁছায় আগের দিন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ভোরের আলো ফোটার আগেই রওয়ানা হলাম আগরতলা স্টেশনের পথে। হোটেল থেকে সঙ্গী হিসেবে পেলাম আসামের আগর ব্যবসায়ী সুভাষ দাকে। দাদা যাবেন আসাম আর আমরা যাব কৈলাসহরের কুমারঘাট। মাঝপথে অটোতে তুলে নিলাম ছোট ভাই অয়নকে। অয়ন ত্রিপুরা এসেছে রাজ্য সরকারের পর্যটন বোর্ডের আমন্ত্রণে।

অল্প সময়েই পৌঁছালাম ট্রেন স্টেশনে। এই অন্ধকার রাতেও জমজমাট পুরো এলাকা। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ জড়ো হয়েছে নিজেদের গন্তব্যে যাবে বলে। কাঞ্চনজঙ্ঘার টিকেট কেটে সুভাষ দার সঙ্গেই এক বগিতে গিয়ে উঠলাম। এর মধ্যেই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। জানালার পাশে মুখোমুখি বসা দুই বয়স্ক ভাই। তাঁরা যাচ্ছেন আসামে বোনের বাড়িতে বেড়াতে। এই বয়সেও ভাইবোনের এমন অটুট পারিবারিক বন্ধন আমাকে মুগ্ধ করে।
ত্রিপুরার মোটামুটি তিন দিক ঘিরেই আছে বাংলাদেশ, আর একদিকে আসাম ও মিজোরাম। বাংলাদেশের সঙ্গে বেশি সীমান্তঘেরা থাকায় এখানকার ভাষা এবং জীবনযাপনে বেশি সাদৃশ্য চোখে পড়ে। অনেকেরই পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ছিল। সেই সূত্রে প্রায় লতাপাতায় আত্মীয়-স্বজন আছে অনেকেরই। যার সঙ্গেই পরিচয় হয়, তাদেরই স্মৃতিচারণমূলক নানা গল্প শুনি। সুভাষ দার সঙ্গেও সুগন্ধি আগরসহ নানান বিষয়ে গল্প হলো।

ঘন্টাখানেক পার হলে ট্রেন ছুটছিল পূর্ণ গতিতে পাহাড়ি রাস্তা ধরে। মাঝে একে একে তিনটা সুড়ঙ্গপথ পাড়ি দিলাম। চমৎকার এক অভিজ্ঞতা বটে। এক্সপ্রেস ট্রেন হওয়াতে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কুমারঘাট। ট্রেন থেকে নেমে নাশতা সেরে রিজার্ভ অটো নিলাম ঊনকোটির উদ্দেশে। ত্রিপুরার এই দিকটা আমাদের মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ সীমান্তবর্তী। উন্নয়নের ছোঁয়া খুব যে লেগেছে তা নয়। যাওয়ার পথের রাস্তাটাও অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশ খারাপ।
পথে দেখলাম নারীরা দলবেঁধে কলসি কাঁধে আসছে। অটো ড্রাইভার সৌরজিৎ জানাল, এদিকের সুপেয় পানির সংকটের কথা। মনু নদী পার হয়ে আমাদের অটো ছুটল পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে। ঘণ্টাখানেক পর এসে পৌঁছালাম ঊনকোটির সদর দরজায়। আমরাই সম্ভবত আজকের প্রথম পর্যটক।
সিঁড়ি ধরে কিছুটা উপরে উঠেই চোখে পড়ল আমার বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই পাথুরে ভাস্কর্যের পাহাড়। পাথুরে পাহাড় খোদাই করে তৈরি করা শত শত বছরের পুরোনো এসব ভাস্কর্যের দিকে কেবল হা হয়েই তাকিয়ে থাকতে হয়। কী অসাধারণ মানুষের হাতের কাজ। মানুষ চাইলে আসলে কত অসাধ্যই না সাধন করতে পারে।

ঊনকোটি মানে কোটির চাইতে এক কম। আগরতলা শহর থেকে ১৭৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই রহস্যময় পাহাড়ি এলাকা। ঊনকোটি নিয়ে নানা মিথ ও কাহিনি প্রচলিত। এর মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত হলো, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভগবান শিব কাশি যাওয়ার পথে এখানে থেমেছিলেন। তিনিসহ দেবতাদের সংখ্যা ছিল এক কোটি। তাঁদের সবার রাত কাটানোর ব্যবস্থা হয় এই পাহাড়েই। পরের দিন সকালে ফেরার সময় ক্লান্ত দেবতাদের কারো ঘুম না ভাঙায় শিব বিরক্ত হন। তাঁর অভিশাপেই ঊনকোটি দেবতা পাথর হয়ে যায়।
তবে ঐতিহাসিকদের মতে, ঊনকোটির এই ভাস্কর্যগুলোর সৃষ্টি অষ্টম অথবা নবম শতকে। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা মূর্তিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিব এবং সুবিশাল কালভৈরবের মূর্তি। এ ছাড়া আরো দেখা মেলে গণেশ, দুর্গা, বিষ্ণু, রাম, রাবণ, হনুমানের মূর্তি। কালের বিবর্তনে বেশ কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও বেশির ভাগই এখনো অক্ষত রয়েছে।
আগের দিন পর্যন্ত আগরতলার ব্যাংকার মনোজ দা ছাড়া সবাই বলেছে, এক দিনের মধ্যে দেখে ফিরে আসতে পারব না। হাতে যদিও সময় কম তবু চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলাম। সব কিছু সময় অনুযায়ীই হয়েছিল, তাই দুপুরের মধ্যেই ঊনকোটি দেখা শেষ হলে ফেরার পথ ধরেছি। ছুটির দিন হওয়াতে ট্রেন বেশ ফাঁকাই ছিল। ট্রেনের শিডিউল অনুযায়ী সন্ধ্যার মধ্যেই পৌঁছাতে পারব আগরতলা। মাথায় ঘুরছে আজ রাতটা আগরতলা না কাটিয়ে অন্য কোথায় কাটানো যায়। সে গল্প না হয় তোলা থাকল পরের পর্বের জন্য।