অচেনা চীনে

জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে সুদূর চীন পর্যন্ত যাওয়ার জন্য বলেছেন নবীজি (সা.)। আর সেই সুবর্ণ সুযোগ করে দিল চীন সরকার, তাদের আমন্ত্রণে ঘুরে এলাম অসম্ভবকে সম্ভব করার দেশে।
গত ২৫ থেকে ২৯ মে, এ কয়েক দিন ছিল সব চমকপ্রদ আয়োজন। ১০০ জনের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ দলে ছিল বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যুব সংগঠক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১০০ জন প্রতিনিধি। এদের তিনটি দলে ভাগ করা হয়। তিনটি দলের দলনেতা ছিলেন মোহাম্মাদ গোলাম কিবরিয়া (সিনিয়র সহকারী সচিব), মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী (উপসচিব) ও এ এস এম মামুন (পিএস)। আমাদের পুরো প্রতিনিধিদলের প্রধান ছিলেন যিনি, তিনি নুমেরি জামান। তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমাদের গন্তব্য শহর ছিল রাজধানী বেইজিং, অনেক সময় পিকিং নামেও ডাকা হয় একে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতি শহরের একটি।
আমরা আমাদের নির্দিষ্ট দিনে ইস্টার্ন চায়না বিমানে করে ছুটলাম বেইজিংয়ের পথ। প্লেন তো না যেন লোকাল বাস, পুরোটা পথ ঝাঁকি খেতে খেতে মোটামুটি জামভর্তা হওয়ার অবস্থা। মনে মনে ভাবছিলাম, মেঘের ভেতরেও কি খানাখন্দ, গতিরোধক আছে নাকি? বেইজিং এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেখি আমাদের গাইড হ্যাপি, ডেভিডসহ আরো অনেকে অপেক্ষা করছেন, তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম আমাদের সফরকে সুন্দর ও সফল করতে সাহায্য করেছে।
শহরটি বেশ পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি, তাই নেমেই ভালো লেগে গেল শহরটাকে। একসময়ে ট্রাফিক জ্যামের জন্য প্রসিদ্ধ বেইজিংয়ে প্রচুর সাবওয়ে স্কাই ট্রেন ও ফ্লাইওভার তৈরি হওয়ায় যানজট এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত।
পাঁচ দিনের এই সফরে আমরা ঘুরেছি, দেখেছি ঐতিহাসিক নিদর্শন—চীনের প্রাচীর, সেই ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি এই প্রাচীরের নাম, তাই এটা দেখার আলাদা কৌতূহল আমাদের সবার। আমার মতে, আগ্রা ঘুরে তাজমহল না দেখা আর চীন দেশ ঘুরতে এসে প্রাচীর না দেখা গুরুতর অপরাধ। প্রাচীর দর্শন শেষে রওনা হলাম ‘পাখির বাসা’ নামক Beijing National Stadium দেখতে। এখানে ২০০৮ সালে অলিম্পিক গেম অনুষ্ঠিত হয়। অসাধারণ এই স্টেডিয়ামের নির্মাণশৈলী।
তার পর আমাদের গাইড ‘চায়নিজ অ্যাক্রোবেটিক শো’ দেখানোর জন্য সেই অলিম্পিক স্টেডিয়াম থেকে নিয়ে এলো চাওইয়াং থিয়েটারে, খুব একটা আগ্রহ পাচ্ছিলাম না, তার পরও বিরক্তি ও ক্লান্তি নিয়ে শো দেখতে ঢুকলাম। সামনাসামনি দেখার আনন্দ যে অন্য রকম, তা ঢুকে টের পেলাম। আলোর কারসাজির সঙ্গে চটকদার জামা পরে যখন ওরা বাজনার সঙ্গে সঙ্গে খেলাগুলো দেখাচ্ছিল, তখন বেশ ভালোই লাগল। আমাদের দেশে দেখেছি, গোলঘরে মোটরসাইকেল চালনা, একে ‘মৃত্যুকূপ’ বলা হতো। এবার দেখলাম, একটি গোল করে মধ্যে একসঙ্গে আটটি মোটরসাইকলে চালনা । শ্বাসরুদ্ধকর এবং এককথায় দারুণ!
সফরের তৃতীয় দিন ছিল ব্যস্ত সময়সূচি, খুব ভোরবেলা আমরা রওনা হই তিয়ানজিনের পথে, প্রথমে আমরা গুইফ্যাক্সইয়াঙ্গ ফুড করপোরেশন পরিদর্শন করি, তার পর তিয়ানজিন পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে মিলিত হই।
শেষ দিনে আমরা যাই আজব এক নগরীতে। বেইজিং স্কয়ারে তিয়ানজিনের পাশেই রয়েছে ১৪০০ শতাব্দীতে নির্মিত ফরবিডেন সিটি।
৯৮০টি বাড়ি ও নয় হাজার ৯৯৯টি কামরা নিয়ে নির্মিত এক এলাহি প্রাসাদ। সে সময়ে সাধারণ জনগণের প্রবেশ নিষেধ ছিল বলেই এই নাম; কিন্তু এখন পর্যটনের জন্য পুরো প্রাসাদটি খুলে দেওয়া হয়েছে। লম্বায় দেড় কিলোমিটার এই প্রাসাদ হেঁটে দেখতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায়। বৃদ্ধদের ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য রয়েছে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা।
বেইজিং হলো ইলেকট্রনিক এবং ঘর সাজানোর নানা শৌখিন জিনিসের স্বর্গরাজ্য। দামাদামি করাটা এখানে রীতিমতো একটি শিল্প। এই শিল্প অদক্ষ হলেই ধরা খেতে হবে অবধারিতভাবে। সাধ্যের মাঝে কিছু সুভ্যেনির নিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। ঘুরে দেখার বাড়তি আনন্দ হলো কেনাকাটায়। ভ্রমণ থেকে ফিরে এসে এই সুভ্যেনির আর ছবিগুলো উল্টেপাল্টে দেখে বহুদিন পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতিগুলোকে সতেজ রাখা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, চীন সম্পর্কে এতদিন যে ধারণা ছিল, সেটি অনেকখানি পাল্টে গেছে এই ভ্রমণের মাধ্যমে। চীনা স্বেচ্ছাসেবকদের আন্তরিকতা, কাজের প্রতি তাঁদের মনোযোগ, নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা এই জিনিসগুলো আমাকে আমার দেশে এবং আমার দায়িত্ব সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করছে। এই ভ্রমণের মাধ্যমে নতুন অনেক বন্ধুও হয়েছে। সব মিলিয়ে যতটা আশা করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি এই ছয় দিনের চীন সফর থেকে।