বিশ্বের ৬৫০ শহরে তানভীরের পা!

টিভির পর্দায় অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান সুলেমানকে নিয়ে ইতিহাস-আশ্রিত ধারাবাহিক দেখে রীতিমতো রোমাঞ্চিত বাঙালি দর্শক। হেরেমে ওয়ালিদে সুলতান ও রক্ষিতাদের দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার লালসায় খুনোখুনি আর বাদশার অফুরান ভোগবিলাসের চিত্ররূপ দেখে দর্শকের সাধ জাগে—যদি একবার সেই হেরেমখানা চর্মচোখে দেখা যেত!
তুরস্কে সুলতান সুলেমানের সেই রাজকীয় হেরেমখানাও দেখতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের তানভীর অপু। সেটি এখন জাদুঘর। নাম তক্কাপি মিউজিয়াম। প্রায় ৫০০ বছর পৃথিবীর রাজধানী ছিল তুরস্কের ইস্তাম্বুল। শাসন করেছেন অটোমান বাদশারা। সুলতান সুলেমানের ব্যবহৃত বিলাসসামগ্রী দেখে কী মনে হয়েছিল তানভীরের? কার না সাধ জাগে সুলতান হওয়ার! তানভীরও এমনটাই বললেন—‘ইশ, যদি সুলতান সুলেমান হতাম!’
আইসল্যান্ডের রেজেভিক শহরে তানভীর অপু
তানভীর অপুকে ভ্রমণবিলাসী বলা যায় না, বলা যায় ভ্রমণপিপাসু। পৃথিবীর নানা দেশে পা রাখেন তিনি, তার ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। যে দেশেই যান, লাল-সবুজে আঁকা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন তানভীর। এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৬৫০টিরও বেশি শহর ভ্রমণ করেছেন তিনি। প্রায় ৬৫টি দেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর। এনটিভি অনলাইনকে তানভীর অপু বলেছেন, এ পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার কিলোমিটার গাড়ি-ভ্রমণ করেছেন তিনি।
এই তো কিছুদিন আগেই মার্কিন মুলুকে গিয়েছিলেন তিনি। ঘুরেছেন ৩০টি রাজ্যে। গাড়ি-ভ্রমণ করেছেন প্রায় ৩০ হাজার কিলোমিটার।
ভ্রামণিক তানভীরের বাড়ি রাজশাহী জেলায়। ২০০৬ সালে তিনি পড়াশোনার উদ্দেশে যান ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ডে। এরপর নেশা চাপে শহর পরিক্রমার। প্রথম ভ্রমণে যান এস্তোনিয়ার রাজধানী তালিমে। সেই থেকে দীর্ঘ এক যুগে ভ্রমণ করেছেন পৃথিবীর ৬৫০টিরও বেশি শহর।
কেন এই ভ্রমণের নেশা? তানভীর বলেন, ‘আমার কাছে পৃথিবীটাই একটি দেশ। আমরা মানুষ, এটাকে ভাগ করেছি। এজন্য বিভিন্ন দেশ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের যেমন ধরুন ৬৪ জেলা, আমাদের উচিত প্রত্যেক জেলায় ভ্রমণ করা। আমাদের ভাষা বাংলা হলেও প্রত্যেক জেলার ভাষায় আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। খুলনায় যেমন সুন্দরবন আছে, সিলেটে আছে চা বাগান। সব দেখা উচিত। যখন ভ্রমণ শুরু করেছি, ভেবেছি পৃথিবীর প্রত্যেক প্রান্তে আমি পা রাখব।’
কিন্তু ভ্রমণ করতে তো আর্থিক সঙ্গতির দরকার। তাহলে? তানভীর বলেন, ‘ভ্রমণ করতে টাকার চেয়েও দরকার বড় মন। আমি যেখানেই গিয়েছি, সেখানে কিন্তু ফাইভ বা ফোর স্টার হোটেলে থাকিনি। সবসময় ছিলাম সস্তা হোটেলে। হেঁটে হেঁটে ঘুরেছি, খেয়েছি সস্তা খাবার। বাংলাদেশে যেমন চিৎকাত বোর্ডিং আছে, ইউরোপে আছে ইউরো হোস্টেল। সস্তায় থাকা-খাওয়া যায়।’
ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি শহরে তানভীর অপু
তানভীর মনে করেন, ভ্রামণিক হতে হলে আগে আরাম-আয়েশ ত্যাগ করতে হবে। হেঁটে যেতে হবে বহু দূর। আর না হাঁটলে একটি শহরের কিছুই দেখা হবে না।
তবে ভ্রামণিক হতে হলে যে শুধু সুইজারল্যান্ড বা নরওয়ে বা অন্য দেশে যেতে হবে এমন কথা মানতে নারাজ তানভীর অপু। নিজের দেশের সব জায়গা ঘুরে দেখলেও অনন্য অভিজ্ঞতা হয়। তা ছাড়া পাশের দেশ তো আছেই। তানভীর বলেন, ‘পুরো ভারত ভ্রমণ করলেই পৃথিবীর অর্ধেক দেশ ভ্রমণ হয়ে যায়। ভিসা পাওয়াও সহজ। মেঘালয় আমার চোখে দেখা পৃথিবীর সেরা স্থানের একটি। কেরালায় যেতে পারেন, রাজস্থানে যেতে পারেন। ভারত ভ্রমণে খরচও কম।’
পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে ঘুরে খুব কমসংখ্যক বাংলাদেশি ভ্রমণকারীকে দেখেছেন তানভীর। তবে কলকাতার বাঙালিদের দেখেছেন তিনি। বলেন, ‘আমি পৃথিবীর উত্তরের শেষ শহর নরওয়ের হ্যামারফেস্টে গিয়েছি, শেষ প্রান্ত নর্থ ক্যাবেও গিয়েছি; সেখানেও কলকাতার বাঙালিদের দেখেছি। কিন্তু বাংলাদেশিদের দেখিনি। কারণ ভ্রমণের দিক দিয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।’
পৃথিবীর বিখ্যাত সব জাদুঘর দর্শন করেছেন তানভীর অপু। অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। অনেক কিছুই শিখেছেন। তানভীর বলেন, অন্যান্য দেশ থেকে তিনি যে শিক্ষাটা বেশি পেয়েছেন তা হলো সৌজন্যতা, ধন্যবাদ জানানো।
ইতালির রোম শহরে তানভীর অপু
কোন শহর সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে? তানভীর বলেন, ‘শহরকে আমি দুই ভাগে ভাগ করি—ইতিহাস ও প্রকৃতি। ইতিহাসের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে ইতালির রোম। মানুষ যে কী সৃষ্টিশীল তা রোমে না গেলে বুঝতে পারতাম না। মনে হয়েছিল, রোম না দেখে মারা গেলে জীবন অপূর্ণ থেকে যেত। আর প্রকৃতির দিক থেকে সবচেয়ে ভালো লেগেছে নরওয়ের হ্যামারফেস্ট। এ ছাড়া ক্রোয়েশিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অসাধারণ। আর আমার প্রিয় দেশ আইসল্যান্ড। আমার চোখে দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ এটি।’
অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। তানভীর মনে করেন, সঠিক ব্যবস্থাপনা নিতে পারলে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে অন্যতম পর্যটন স্থান। বিশেষ করে খাবারের বৈচিত্র্যের জন্য বাংলাদেশ অনন্য। তানভীর বলেন, ‘সুন্দরবন, দীর্ঘতম সৈকত, সেন্টমার্টিন দ্বীপসহ পুরো বাংলাদেশই সৌন্দর্যের আধার। আপনি দেখবেন, এখানে কত রকমের শাক আছে, মাছ আছে। খাবারের জন্যও পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশ।’
শুধু বিদেশিদের জন্যই নয়, অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন তানভীর অপু। আর এ জন্য তিনি চান যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি। সঙ্গে নিরাপত্তা। তানভীর বলেন, ‘আপনি যদি চট্টগ্রামে যান, যেতেই অনেক সময় চলে যাচ্ছে। এতে ক্লান্তি ভর করছে। তা হলে আপনি কী করে ভ্রমণ করবেন? আর নিরাপত্তার অভাব তো রয়েছেই। কোথাও গেলে চুরি-ছিনতাইয়ের ভয় থাকলে তো ভ্রমণ হয় না।’
তানভীর মনে করেন, ভ্রমণ ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। তা ছাড়া পর্যটনশিল্প থেকে অনেক আয় হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তানভীর বলেন, নেপাল, মালদ্বীপ, মরক্কোর মতো দেশগুলো শুধু পর্যটনের ওপর নির্ভর করে টিকে আছে।
ভ্রমণবিষয়ক একটি বইও লিখেছেন তানভীর অপু। নাম ‘যাত্রা হলো শুরু’। তানভীর চান বাংলাদেশের সব মানুষ ভ্রমণপ্রিয় হয়ে উঠুন। শিগগিরই আসছে তানভীরের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল। সেখানে তাঁর ৬৫০টির বেশি শহর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ভাগ করবেন ভ্রমণপিপাসু সবার সঙ্গে। বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে নিজের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কথাও বলতে চান তানভীর। বলেন, মানুষের মনের গুমোট কাটাতেই ভ্রমণ দরকার।