ছুটির দিনে
সৌন্দর্যমণ্ডিত নাটোর রাজবাড়ি

চলনবিলের সৌন্দর্যমণ্ডিত সুন্দর, ছোট মফস্বল শহর নাটোর। রয়েছে মন মুগ্ধ করার মতো অনেক কিছুই। চলনবিলের সৌন্দর্যের সঙ্গে এখানে অবস্থিত নাটোর রাজবাড়ি আর দিঘাপতিয়ার উত্তরা গণভবন ইতিহাসের স্মারক হিসেবে নাটোরকে করেছে আরো সমৃদ্ধ। আমাদের দেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের মধ্যে শত শত বছরের পুরোনো রাজবাড়িগুলো অন্যতম। এই রাজবাড়িগুলোর ঐশ্বর্য আমাদের বুঝিয়ে দেয় কতটা সমৃদ্ধ ছিল বাংলা, কত রাজার পা পড়েছে এই বাংলায়। এক কথায় এসব হচ্ছে ইতিহাসের জীবন্ত প্রমাণ। তেমনি একটি রাজবাড়ি হচ্ছে নাটোর রাজবাড়ি।
মহারানী ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত এই রাজবাড়ি। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকাজুড়ে যে কটি রাজবাড়ি তাদের স্থাপত্য-শৈলী ও ইতিহাস দিয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে আসছে তার মধ্যে নাটোরের রাজবাড়ি অন্যতম। এই রাজবাড়ির রয়েছে একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস। রাজা রামজীবন নাটোর রাজবাড়ির প্রথম রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন ১৭০৬ মতান্তরে ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন এবং সে বছরেই মৃত্যুবরণ করেন। সম্ভবত ১৭০৬ থেকে ১৭১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৪৯.১৯২৫ একর জমির ওপর নাটোর রাজবাড়ি নির্মিত হয়েছে। রাজা রামজীবনের মৃত্যুর পর রামকান্ত ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে নাটোরের রাজা হন। অনেকের মতে, ১৭৩০ থেকে ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজা রামজীবনের দেওয়ান দয়ারাম নাটোরের তত্ত্বাবধান করতেন। রাজা রামকান্ত তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাটোরের রাজত্ব করেন। রামজীবনের জমিদারির রাজধানী নাটোরে স্থাপনকে কেন্দ্র করে অনেক বিচিত্র জনশ্রুতি আছে। যেমন মায়ের আদেশে রাজা রামজীবন ও রঘুনন্দন নিজ জন্মভূমিতে রাজধানী স্থাপনের জন্য উপযুক্ত একটি স্থানের সন্ধান করতে থাকেন। এক বর্ষাকালে রঘুনন্দন রাজা রামজীবন ও পণ্ডিতবর্গ নৌকায় চড়ে রাজধানী স্থাপনের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচনে বের হন। ঘুরে ঘুরে তাঁরা ভাতঝাড়া বিলের মধ্যে উপস্থিত হন। বিলের একটি স্থানে তাঁরা দেখতে পেলেন, দুটি সাপ সাঁতরে বিল পার হচ্ছে এবং একটি ব্যাঙ ছোট একটি সাপকে গিলে খাচ্ছে।
পণ্ডিতবর্গ সেই স্থানেই রাজধানী নির্মাণের পরামর্শ দেন। রাজা এই স্থানে রাজবাড়ি নির্মাণ করবেন বলে স্থির করেন। রাজবাড়ি নির্মাণ করার পর রাজ-আমলা, কর্মচারী বহুবিধ লোকের সমাগমে অল্পদিনের মধ্যে বিলটি একটি শহরে পরিণত হয়। সেই পরিণত শহরই নাটোর, সেই রাজবাড়িটিই নাটোর রাজবাড়ি। তারপর বহুদিন হয়ে গেছে, নাটোর রাজবাড়ি এখন ভঙ্গুর, তবু ঐশ্বর্যে সে বিস্ময় জাগায়।
নাটোর রাজবাড়ি যাওয়ার জন্য আপনাকে নাটোর শহর থেকে মাদ্রাসা রোড পেরিয়ে বগুড়া রোড ধরে এগোতে হবে। পথে যেতে আপনার নজরে পড়বে ১৮৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত নাটোর মহারাজা জে এন উচ্চ বিদ্যালয়টি। এসব দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন নাটোর রাজবাড়িতে। রাজবাড়িটি বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন রয়েছে। এখানে দেখার মতো রয়েছে অনেক কিছুই। রাজবাড়ির প্রবেশমুখেই বিশাল একটি শানবাঁধানো পুকুর।
রাজবাড়ি ঘিরে আছে বিশাল বিশাল সব গাছ। এখানে জনসমাগম নজরে রেখে নির্মাণ করা হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টার। কমিউনিটি সেন্টার থেকে আরেকটু এগোলেই তারকেশ্বর মন্দির, তার একটু সামনেই ডান পাশে দেখতে পাবেন বিশাল একটি মাঠ। এই মাঠের প্রান্তরে দাঁড়ালেই আপনার নজর কাড়বে রাজবাড়ির একতলা ভবনটি। একতলা এই ভবনটির নাম ছোট তরফ। ছোট তরফ মূলত বিশাল রাজবাড়ির একটি ছোট অংশ। ছোট তরফের ঠিক উল্টো পাশেই বড় তরফ। এই তরফ দুটির পাশে রয়েছে বিশাল পরিখা। পুরো রাজবাড়িতে রয়েছে মোট পাঁচটি পুকুর।
রাজবাড়ির আঙিনায় রয়েছে বিশাল বিশাল আটটি শিবমন্দির। মন্দিরগুলোতে এখনো রীতি মেনে নিয়মিত পূজা-অর্চনা করা হয়। দৃষ্টিনন্দন এই মন্দিরগুলো আপনাকে মুগ্ধ করবেই। মন্দিরের দেয়ালজুড়ে রয়েছে প্রাচীন টেরাকোটার শিল্পকর্ম। মন্দিরকে ঘিরে আছে একটি শিবমূর্তি, ফণা তোলা সাপের মূর্তি, একজন বাউলের মূর্তিসহ নানা রকমের শৈল্পিক কারুকাজ। ওপরে ওঠার জন্য প্রতিটি ভবনের পাশেই রয়েছে লোহার তৈরি ঘোরানো সিঁড়ি। ঘুরতে ঘুরতে দেখা মিলে যাবে রানি মহলের। এই মহলটিতেই বাস করতেন রানি ভবানী। নাটোরে এলে বিখ্যাত মিষ্টি কাঁচাগোল্লা খেতে ভুলবেন না যেন।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে দিনে বা রাতের যেকোনো সময় হানিফ, ন্যাশনাল, শ্যামলীসহ বিভিন্ন পরিবহনের বাস চলে এই রোডে। এসব বাসে মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় নাটোর পৌঁছানো যায়। নাটোর শহর থেকে সরাসরি রিকশা বা টেম্পোযোগে যাওয়া যায় রাজবাড়িতে। তারপর শুধু ঘুরে দেখার পালা।
থাকার জায়গা
নাটোরে থাকা-খাওয়ার জন্য রয়েছে বেশ ভালো পরিবেশ। এখানে রয়েছে আরামদায়ক হোটেল। খাওয়াদাওয়া করার জন্যও প্রচুর হোটেল রয়েছে। তবে রাত্রিযাপনের জন্য আগে থেকে হোটেলে বুকিং দিয়ে রাখতে পারেন।