ছুটির দিনে
প্রাণজুড়ানো পঞ্চগড়

সারা বছরই মানুষ ব্যস্ত থাকেন নানা কাজে। কিন্তু যখন ছুটির অবসর আসে তখন যেন ঘরে মন টেকে না। ছুটিতে কি কোথাও বেরিয়ে আসার কথা ভাবছেন? এই অবসরে ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড় থেকে। এত সুন্দর ছিমছাম ছবির মতো সুন্দর জায়গা বাংলাদেশে খুব কমই আছে।
দেশের ভেতরে ঘোরাঘুরির চিন্তা এলেই আমাদের মাথায় ঘোরে কেবল কক্সবাজারের সমুদ্র আর সিলেটের চা বাগানের কথা। কিন্তু এ ছাড়া আমাদের দেশে যে কত চমৎকার সব জায়গা আছে, আর সেসব যে কত নয়নাভিরাম তা বলে বোঝানো যাবে না। তাই বলছি, ভ্রমণপিপাসুদের কাছে পঞ্চগড় হতে পারে এক অসাধারণ জায়গা। পঞ্চগড়ে ঢোকার সাথে সাথে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ দেখে। প্রকৃতিপ্রেমীদের মুগ্ধ করার জন্য শ্রষ্টা যেন নিজ হাতে সাজিয়েছেন পঞ্চগড়কে। পঞ্চগড়ের উল্লেখযোগ্য কিছু স্থানের কথা বলে ফেলি তাহলে।
ভিতরগড় ও মহারাজের দিঘি
উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত ভিতরগড় দুর্গনগরী প্রাচীন যুগের একটি বিরাট কীর্তি। প্রায় ১২ বর্গমাইলজুড়ে এই বিশাল গড় ও নগরীর অবস্থান। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের কারণে এ দুর্গনগরীর কিছু অংশ ভারতের মধ্যে পড়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, এ নগরী নির্মাণ করেন প্রাচীন কামরূপের শূদ্রবংশীয় রাজা দেবেশের বংশজাত পৃথু রাজা। সম্রাট হর্ষবর্ধনের সময় পৃথু রাজার অভ্যুদয় ঘটে।
তিনি কামরূপে পরাজিত হয়ে ভিতরগড় এলাকায় গমন করেন এবং নির্মাণ করেন এই গড়। ভিতরগড় দুর্গে একটি বড় দিঘি (মহারাজার দিঘি) ও কয়েকটি ছোট ছোট দিঘি আছে। ‘মহারাজার দিঘি’ একটি বিশালায়তনের জলাশয়। মাটি থেকে বেশ কয়েট ফুট নিচে এই জলাশয়টি। উঁচু পাড়ে অসংখ্য গাছপালা। রয়েছে বসার জায়গা। পাড়সহ এর আয়তন প্রায় ৮০০ গুণ ৪০০ বর্গগজ। পাড়ের উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। জলভাগের আয়তন প্রায় ৪০০ গুণ ২০০ বর্গগজ। পানির গভীরতা প্রায় ৪০ ফুট বলে স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস। পানি অতিস্বচ্ছ। দীঘিতে রয়েছে ১০টি ঘাট। পানিতে পা রেখে একবার দাঁড়ালে আপনার মনে হবে পৃথিবীর সর্বসুখ এখন আপনার।পঞ্চগড়ের চা বাগান পঞ্চগড়ে কয়েক দশক আগেও কোনো চা বাগান ছিল না। তবে এখন এই এলাকায় গড়ে উঠেছে চা শিল্প। কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের কথা শুরুতে না বললেই নয়। শুধু চা বাগান না, এখানে টি এস্টেটের ভেতরের নির্মাণশৈলীও দারুণ নজরকাড়া। কিন্তু সমস্যা হলো এখানে সব সময় ঢোকা যায় না। কিন্তু ভিতরগড়ের দিকে বেশ কিছু চা বাগান আছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো পঞ্চগড়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের মাঝে চা গাছ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাঝখানে চা বাগান রেখে বাংলাদেশ সীমান্তে দাঁড়িয়ে আপনি দেখতে পারেন অদূরে ভারতের ছোট্ট ছোট্ট গ্রামগুলো।
পঞ্চগড় আসবেন আর তেঁতুলিয়া ঘুরতে যাবেন না তা কী করে হয়? তেঁতুলিয়া যেতে রাস্তার দুই ধারেই দেখবেন সারি সারি চা বাগান। পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়া যেতেই হাতের বাম দিকের চা বাগানগুলো মূলত ভারতের মালিকানাধীন। এ অংশে আপনার অনুপ্রবেশ নিষেধ। অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ হতে পারে, কিন্তু দেখতে তো আর নিষেধ নেই। দু চোখ ভরে দেখে নিন প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য, যার কোনো সীমানা নেই।
বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির
বদেশ্বরী মন্দিরটি পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মৌজার প্রায় ২.৭৮ একর জমিতে (মন্দির ও পার্শ্ববর্তী অংশসহ) অবস্থিত। হিন্দুধর্মের ১৮টি পুরাণের মধ্যে স্কন্ধ পুরাণ একটি। সেই স্কন্ধ পুরাণে বর্ণিত আছে রাজা দক্ষ একটি যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন। ভোলানাথ শিব রাজা দক্ষের জামাই ছিলেন। রাজা দক্ষ কখনই শিবকে জামাই হিসেবে মেনে নেননি। কারণ মহাবীর শিব সর্বদাই ছিলেন উদাসীন এবং নেশা ও ধ্যানগ্রস্ত। ওই যজ্ঞানুষ্ঠানে মুনি-ঋষি ও অন্য দেবতারা নিমন্ত্রিত হলেও রাজা দক্ষের জামাই তথা দেবী দুর্গার স্বামী ভোলানাথ শিব নিমন্ত্রিত ছিলেন না। এ কথা শিবের সহধর্মিণী জানামাত্রই ক্ষোভে দেহত্যাগ করেন। শিব তাঁর সহধর্মিণীর মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে উন্মাদ হয়ে তাঁর সহধর্মিণীর শবদেহটি কাঁধে নিয়ে পৃথিবীর সর্বস্তরে উন্মাদের মতো ঘুরতে থাকেন এবং প্রলয়ের সৃষ্টি করেন। সে মুহূর্তে স্বর্গের রাজা বিষ্ণুদেব তা সহ্য করতে না পেরে স্বর্গ থেকে একটি সুদর্শন চক্র নিক্ষেপ করেন। চক্রের স্পর্শে শবদেহটি ৫২টি খণ্ডে বিভক্ত হয়। শবের ৫২টি খণ্ডের মধ্যে বাংলাদেশে পড়ে দুটি খণ্ড। একটি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে এবং অপরটি পঞ্চগড়ের বদেশ্বরীতে।
মহামায়ার খণ্ডিত অংশ যে স্থানে পড়েছে, তাকে পীঠ বলা হয়। বদেশ্বরী মহাপীঠ এরই একটি। ওই মন্দিরের নাম অনুযায়ী বোদা উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে। করতোয়া নদীর তীরঘেঁষে নির্মিত বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দিরটি এখন প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের নিদর্শন বহন করে।
বাংলাবান্ধা জিরো (০) পয়েন্ট ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর
বাংলাদেশের সর্ব-উত্তরের উপজেলা তেঁতুলিয়া। এই উপজেলার ১ নম্বর বাংলাবান্ধা ইউনিয়নে অবস্থিত বাংলাদেশ মানচিত্রের সর্ব-উত্তরের স্থান বাংলাবান্ধা জিরো (০) পয়েন্ট ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। এই স্থানে মহানন্দা নদীর তীর ও ভারতের সীমান্তসংলগ্ন প্রায় ১০ একর জমিতে ১৯৯৭ সালে নির্মিত হয় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। নেপালের সাথে বাংলাদেশর পণ্যবিনিময়ও সম্পাদিত হয় বাংলাবান্ধা জিরো (০) পয়েন্টে।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর
উক্ত স্থান হতে হেমন্ত ও শীতকালে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য বেশ উপভোগ করা যায়। বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের স্থান বলেই শীতকালে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটকের আগমন ঘটে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে।
তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরে একটি ঐতিহাসিক ডাকবাংলো আছে। এর নির্মাণ কৌশল অনেকটা ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের। জানা যায়, কুচবিহারের রাজা এটি নির্মাণ করেছিলেন। ডাকবাংলোটি জেলা পরিষদ পরিচালনা করে। এর পাশাপাশি তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদ একটি পিকনিক স্পট নির্মাণ করেছে। ওই স্থান দুটি পাশাপাশি অবস্থিত হওয়ায় সৌন্দর্যবর্ধনের বেশি ভূমিকা পালন করছে। সৌন্দর্যবর্ধনে এ স্থান দুটির সম্পর্ক যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। মহানন্দা নদীর তীরঘেঁষা ভারতের সীমান্তসংলগ্ন (অর্থাৎ নদী পার হলেই ভারত) সুউচ্চ গড়ের ওপর সাধারণ ভূমি থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিটার উঁচুতে ডাকবাংলো ও পিকনিক স্পট অবস্থিত। ডাকবাংলোর বারান্দায় দাঁড়ালে আপনার চোখে পড়বে ভারত-বাংলাদেশের অবারিত সৌন্দর্য। ওই স্থান থেকে হেমন্ত ও শীতকালে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বর্ষাকালে মহানন্দা নদীতে পানি থাকলে এর দৃশ্য আরো বেশি মনোরম হয়। করতোয়ার পাড়
এই জায়গাটা ঘোরার জন্য তেমন পরিচিত নয়। তবে যাঁরা দু চোখ ভরে জলমাটি প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে চান, তাঁদের জন্য করতোয়ার পাড় হতে পারে দারুণ জায়গা। যদিও করতোয়া নদীটি বেশ সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছে, তারপরও এখানে একটু সময় নিয়ে বসলে আপনার প্রাণ জুড়িয়ে যাবে।
মির্জাপুর শাহি মসজিদ
মির্জাপুর শাহি মসজিদটি আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে অবস্থিত। সম্ভবত ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত ঢাকার হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত মসজিদের সাথে মির্জাপুর শাহি মসজিদের নির্মাণশৈলীর সাদৃশ্য রয়েছে। এ থেকে ধারণা করা হয়, ঢাকার হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত মসজিদের সমসাময়িককালে মির্জাপুর শাহি মসজিদের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। দোস্ত মোহাম্মদ এটির নির্মাণকাজ শেষ করেন বলে জানা যায়। মসজিদের নির্মাণ সম্পর্কে পারস্য ভাষায় লিখিত মধ্যবর্তী দরজার উপরিভাগে একটি ফলক রয়েছে। ফলকের ভাষা ও লিপি অনুযায়ী ধারণা করা হয়, মোগল সম্রাট শাহ আলমের রাজত্বকালে এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। মসজিদটির দেয়ালের টেরাকোটা ফুল ও লতাপাতার নকশা খোদাই করা রয়েছে।
কীভাবে যাবেন
সরাসরি পঞ্চগড় যেতে হলে আপনি হানিফ কিংবা নাবিল পরিবহনে যেতে পারেন। ভাড়া পড়বে ৪০০-৫০০ টাকার মধ্যে। বাসগুলোতে যেতে পারেন। যদি এসি বাসে যেতে চান তাহলে আপনার জন্য রয়েছে গ্রীন লাইন, আগমনী, টি-আর ট্র্যাভেলস বাসগুলো। ভাড়া লাগবে ৭৫০-৮০০ টাকার মতো। তবে সমস্যা হলো এই বাসগুলো যায় রংপুর পর্যন্ত। রংপুর থেকে পঞ্চগড়ে আপনাকে আলাদা পরিবহনে যেতে হবে। এখানকার বিভিন্ন স্থানে বেড়ানোর জন্য পঞ্চগড় শহর থেকে গাড়ি বা মাইক্রোবাস ভাড়া করে যাওয়া ভালো। সারা দিনের জন্য এসব জায়গা ঘুরতে রিজার্ভ কারের ভাড়া পড়বে ২০০০-২৫০০ টাকা আর মাইক্রো বাসের ভাড়া পড়বে ২৫০০-৩৫০০ টাকা। পঞ্চগড় কেন্দ্রীয় বাসস্টেশন এবং শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে এসব ভাড়ার গাড়ি পাওয়া যাবে।
কোথায় থাকবেন
পঞ্চগড় শহরে থাকার জন্য বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। এর মধ্যে শহরের তেঁতুলিয়া রোডে হোটেল মৌচাক। এসব হোটেল এসি/নন এসি নিয়ন্ত্রিত। এগুলোতে ডবল, সিঙ্গেল কক্ষ আছে। আর বিভিন্ন রকম কক্ষের প্রতিদিনের জন্য ভাড়া ১৫০-৬০০ টাকা। যা আপনার নাগালের মধ্যেই।
লেখাটি পড়তে পড়তে হয়তো এই ছুটিতে পঞ্চগড় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন কেউ কেউ। তবে ঘুরে আসুন বাংলাদেশের সবচেয়ে উত্তরের দিকটা। আপনার ভ্রমণ আনন্দময় হোক।