পানির দেশ হাওর দ্বীপ অষ্টগ্রাম

আর মাত্র কদিন। এরপরই শুরু হচ্ছে বর্ষাকাল। আমরা সাধারণত বর্ষাকালকে বেড়ানোর জন্য উপযুক্ত মনে করি না। তবে বর্ষাকালও কিন্তু বেড়ানোর জন্য উপযুক্ত একটি ঋতু, যদি আপনি সঠিক লোকেশন খুঁজে নিতে পারেন। এমনি একটি স্থান হলো কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম। অষ্টগ্রাম উপজেলা হাওরবেষ্টিত যোগাযোগবিচ্ছিন্ন একটি উপজেলা। এর চারদিকেই পানি। এমনকি শীতের সময়েও এখানে যেতে হলে নৌপথের সাহায্য নিতে হয়। এমন একটি স্থানে বর্ষাকাল কতটা সুন্দর আর উপভোগ্য হয় নিজে গিয়ে সেটা দেখে নিন।
তবে শুধু বর্ষায় নয়, অষ্টগ্রাম যাওয়া যায় যে কোনো সময়। এবার বর্ষা শুরুর আগে অষ্টগ্রামের রূপ কেমন হয় সেটা দেখতে হয়তো আপনার মনটা ছটফট করতে পারে। আপনি একটা ক্যাম্পিং ট্যুর দেওয়ার চিন্তা করতে পারেন।
তো কোনো এক শুক্রবার সকালে গুলিস্তান থেকে বিআরটিসির বাসে রওনা দিতে পারেন কুলিয়ারচরের উদ্দেশে। ঘণ্টা আড়াই পরে কুলিয়ারচর পৌঁছাতে পারেন। পৌঁছে আগে থেকে রিজার্ভ করা নৌকায় উঠতে পারেন। বড় নৌকাটি মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে ছোট নদী আর হাওর পেরিয়ে যেতে থাকবে। দুই পাশে চর, লোকালয় মাঝে ছোট্ট নদী বেয়ে সবকিছু ফেলে নৌকা এগোতে থাকবে। সবাই মিলে তখন নৌকার ছাদের উঠে প্রকৃতি দেখতে পারেন। চারপাশে একটু পরপর পাখির সমারোহ। আপনার ক্যামেরা ব্যস্ত হয়ে পড়তে পারে পাখি আর প্রকৃতির ছবি তোলায়। আবার নৌকার ছাদে গোল হয়ে বসে গান শুরু করতে পারেন। একটু পরপর ছোট্ট একেকটা দ্বীপের মতো আপনার চোখে পড়বে। সেখানে অনেক বাড়িঘর। সেগুলো আবার বেশ শক্তপোক্ত এবং রঙিন। বোঝা যায়, এখানকার লোকজন বেশ অবস্থাসম্পন্ন। এসব দ্বীপে যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো নৌকা বা ট্রলার। কয়েকটিতে দেখতে পাবেন সাইক্লোন/বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর অষ্টগ্রাম পৌঁছাতে পারেন। চারদিকে হাওরবেষ্টিত যোগাযোগবিচ্ছিন্ন উপজেলা অষ্টগ্রামে আয়তন ৩৩৫ বর্গকিলোমিটার। জানা যায় অষ্টগ্রাম,আসিয়া, দুবাই ভাটেরা, নরসিংহ পূর্ববাদ, খাসাল, বীরগাঁও, বত্রিশগাঁও এবং বারেচর এই আটটি মৌজা নিয়ে গঠিত হওয়ায় এই জনপদের নাম অষ্টগ্রাম।
অষ্টগ্রাম পৌঁছেই চমকে যেতে পারেন এর পরিবর্তন দেখে। রাষ্ট্রপতির নির্বাচনী এলাকা হওয়ায় এখানে তিনি বিশেষ নজর রাখেন। যোগাযোগবিচ্ছিন এ দ্বীপে তিনি দারুণ সব রাস্তা ঘাট আর ব্রিজ করেছেন। চেনাই যায় না গত দুই বছর আগের অষ্টগ্রামকে। বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত পুরো লোকালয়। যদি আপনি ক্যাম্পিং করতে চান, তাহলে নৌকা থেকে নেমে প্রথমে থানায় রিপোর্ট করতে হবে আপনাকে। ক্যাম্পিং করতে পুলিশকে আগেই জানিয়ে রাখলে বিপদে সাহায্য নেওয়া যায়। আর বাইরে থেকে গেলে বা ঢাকা থেকে ঘুরতে গেলে থানা অনুমতি দেবে ক্যাম্পিং করার।
থানার কাছেই একটি চরে ঘাসের গালিচায় ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। প্রথমেই আপনি বা আপনারা নিজেদের তাঁবু পিচ করে নিতে পারেন। মোট পাঁচটা তাঁবুতে ১০ জন থাকা যাবে। বাকি যাঁরা টেন্ট আনেননি, তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হতে পারে ডাকবাংলোতে। এলাকার লোকজন এমন টেন্ট আগে দেখেননি। তাই তাঁরা এই তাঁবু দেখে অনেকে হাত লাগাতে পারেন কাজে। থাকার ব্যবস্থার পর এবার দুপুরে খাবারের পালা। এ বেলা রেস্টুরেন্টে খেতে হবে আপনাকে। আপনি আগেই অষ্টগ্রাম বাজারের দোকানি বাবুলকে ফোন করে অর্ডার দিতে পারেন খাবারের। তিনি আপনার জন্য আলাদাভাবে স্থানীয় চাল দিয়ে ভাত, ভাজি, আইড় মাছ, আলু ভর্তা আর ডাল রান্না করে রাখবেন। বাবুলের রান্না অসাধারণ। আপনার পেটে যদি ক্ষুধা থাকে, তাহলে তো আর কথাই নেই। তাই সবাই পেট ভরে বাবুলের দোকানে খেতে পারেন।
খাবার পর গরুর দুধের চা খাওয়ার পালা। অষ্ট্রগ্রামে প্রচুর দুধ পাওয়া যায়। এখানকার পনিরও বিখ্যাত। চা খেতে খেতে আর আড্ডা দিতে দিতে প্রায় অনেক সময় চলে যেতে পারে। এবার আপনি কুতুব শাহ মসজিদ দেখতে যেতে পারেন। আপনি রিকশা নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন কুতুব শাহ মসজিদ। অনেক পুরোনো মসজিদ এ কুতুব শাহ। ধারণা করা হয়, ১৬ শতকের শেষদিকে বা ১৭ শতকের প্রথম দিকে একজন বুজুর্গ কুতুব শাহ মসজিদটি তৈরি করেন। পাঁচ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির কারুকাজ অসাধারণ। এত বছর পরেও মসজিদটি মোটামুটি ভালো অবস্থাতেই আছে। আপনি সেখানে আসরের নামাজ পড়তে পারেন। আর যদি সেদিন থাকে ওরস, তাহলে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হবে কুতুব শাহ (রহ.) মাজারে। মাজারের পাশেই মেলা বসে। দোকান আর মানুষে হাঁটাচলাই মুশকিল হয়ে পড়তে পারে।
সেখানে আর না দাঁড়িয়ে আপনি চলে যেতে পারেন রিকশা নিয়ে নদী তীরে একটি ছোট বাজারে। এল শেপ কিছু দোকানপাট আর ছোট একটা মাঠ। দারুণ আড্ডার জায়গা এটি। আপনি একটি দোকানে শিঙ্গাড়া ভাজার অর্ডার দিয়ে হাওরের বাতাসে আড্ডায় মেতে উঠতে পারেন। মাঝে আপনি পনির ওয়ালাকে খবর দিতে পারেন। একটু পরেই টাটকা পনির নিয়ে হাজির হবে পনিরওয়ালা। প্রতি কেজি ৫০০ টাকা করে। আপনি ইচ্ছে করলে অর্ডার দিতে পারেন। এরপর আপনি ফিরে আসতে পারেন ক্যাম্পে।
খাবার পর আড্ডা আর গানের আয়োজন হতে পারে। রাতে আপনি মেলায় যেতে পারেন। রাতে মানুষ আরো বাড়ে। পা রাখার জায়গা থাকে না পুরো এলাকায়। পুরো এলাকা আলোয় আলোকিত। আপনি মেলায় কিছু গ্রামীণ রাইডে চড়তে পারেন। ভোরে আপনার পাখির ডাকে ঘুম ভাঙতে পারে
এরপর সবাই নাশতা করে বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে পারেন। যেতে ইচ্ছে করবে না আপনার। কিন্তু যেতে হবে। কারণ ঢাকায় সবারই কাজ আছে। তাই আপনাকে নৌকায় উঠতে হবে। বিদায় নিতে হবে। মনে মনে আপনি বলতে থাকবেন বিদায় অষ্টগ্রাম। আবার দেখা হবে কোনো এক বর্ষায়।
যেভাবে যাবেন : সবচেয়ে ভালো হলো ট্রেনে যাওয়া। প্রতিদিন সকাল ৭টায় এগারসিন্দুর প্রভাতি (বুধবার বন্ধ) ছাড়ে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে। এতে উঠে কুলিয়ারচর নেমে পড়ুন। ভাড়া ১২০ টাকা। এ ছাড়া গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া থেকে বিআরটিসি বাসে করেও কুলিয়ারচর যাওয়া যায়। ভাড়া ২০০ টাকা। যাঁরা ভৈরব হয়ে যেতে চান, তাঁরা ভৈরব নেমে সিএনজিতে করে কুলিয়ারচর যাবেন। শেয়ারে ভাড়া নেবে জনপ্রতি ৪০ টাকা।
কুলিয়ারচর নেমে একটা রিকশা নিয়ে চলে যান লঞ্চঘাট। এখান থেকে প্রতিদিন সকাল ৬টা, ৮টা, ৯টা, ১১টা এমনি করে ৩টা পর্যন্ত লঞ্চ ছেড়ে যায় অষ্টগ্রাম। ভাড়া ১০০ টাকা। সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘণ্টা।
গ্রুপ ট্যুরে গেলে আগে থেকে জানালে ট্রলার নিয়ে হাজির হবে। এই নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৭৬-১৮৫১৪৪১ (খোকন)। এটি ১৫-২০ জন গ্রুপের বড় নৌকা দুদিনের জন্য নিতে পারে চার থেকে ছয় হাজার টাকা।
কোথায় থাকবেন : থাকার বেশ কটি অপশন আছে। নিজেরা টেন্ট নিয়ে ক্যাম্পিং করতে পারেন। আছে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো। কেয়ারটেকার এর নম্বর দিলাম ০১৯১৪-৯৭৫৩৮৯। আগে কথা বলে বুকিং দিতে পারেন। ভাড়া ৩০০-১৫০০ টাকা (রুম ভেদে)। এ ছাড়া বাজারে দুটি সাধারণ মানের হোটেল আছে, ভাড়া ১০০-২০০ টাকা।