আলজাজিরার প্রতি সৌদির এত বিদ্বেষ কেন?

আরবের বহু নেতা আলজাজিরাকে কেন ঘৃণা করেন, তা বুঝতে চাইলে ‘শরিয়া অ্যান্ড লাইফ’ অনুষ্ঠানটিকে বিবেচনায় নিতে পারেন। কয়েক বছর ধরে ইসলামবিষয়ক বিভিন্ন জিজ্ঞাসার এই অনুষ্ঠানটি আলজাজিরার অন্যতম জনপ্রিয় শোর একটি, যার লাখ লাখ দর্শক আছে।
ওই অনুষ্ঠানটিতে মিসরের আলেম ও মুসলিম ব্রাদারহুডের আধ্যাত্মিক নেতা ইউসুফ আল-কারজাভীর কাছে ধর্মীয় বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন দর্শকরা। যেমন : রমজানে কি ধূমপান করা যায়? আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানোর সময় ফিলিস্তিনের কোনো নারীকে কি হিজাব পরতে হবে?
কাতারের দোহাভিত্তিক এই চ্যানেলটি চালু হওয়ার আগে গণমাধ্যমের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা আরববিশ্বে এ ধরনের একটি অনুষ্ঠানের কথা ভাবাই যেত না। অথচ কাতারের মালিকানাধীন চ্যানেলটির বিভিন্ন বিষয়ে (অনেক ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ বিষয়ে) উচ্চাকাঙ্ক্ষী সাংবাদিকতার সুযোগ আছে।
আরবের অধিকাংশ গণমাধ্যমের তুলনায় চ্যানেলটিতে বিভিন্ন ইস্যুতে বেশি মতামত প্রচারিত হয়। আর এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় চ্যানেল হয়েছে এটি। একই সঙ্গে শত্রুও বেড়েছে সমানতালে।
আলজাজিরার এত বিস্তৃতি এবং বিরোধীদের চাঙ্গা করে তুলতে চ্যানেলটির কার্যক্রমে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছ সৌদি আরব ও মিসরের শাসকগোষ্ঠী। ইসলামপন্থীদের সঙ্গে আলজাজিরার সখ্য, কাতারের বিভিন্ন কর্মসূচির প্রতি সমর্থন এবং সরকারের নানা সমালোচনাও পছন্দ নয় আরব শাসকদের।
কয়েক বছর ধরেই আলজাজিরাকে নিজের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াতে বলছিল আরব কয়েকটি দেশ, অন্যথায় তাদের কার্যক্রম বন্ধের হুমকি দিয়েছিল। হয়েছেও তাই। সৌদি আরব, মিসর ও জর্দান তাদের দেশে আলজাজিরা ব্যুরো বন্ধ করে দিয়েছে। আর এর আগেই আরব দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে কাতার। সৌদির নেতৃত্বাধীন দেশগুলোর অন্যতম দাবি, বন্ধ করতে হবে আলজাজিরা।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৩৫ কোটি আরবি ভাষী মানুষ রয়েছে। ১৯৫০ ও ’৬০-এর দশকে রেডিওগুলো বিপুল এই জনতার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের প্যান-অ্যারাবিস্ট বা আরব ঐক্যের ধারণাগুলো ছড়াতে সওত আল-আরব রেডিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
১৯৯০-এর দশকে সৌদি রাজপরিবার আরব সংবাদপত্রগুলো কিনতে শুরু করে এবং সেগুলো আরব অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। বিস্তৃত পরিসরে দর্শক টানতে এমবিসি নামের একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলও চালু করে তারা। এই চ্যানেলটির কার্যক্রমে বোঝা যাচ্ছিল, তারা আরবদের প্রভাবশালী গণমাধ্যম হতে যাচ্ছে। আর এর মধ্য দিয়ে আরব নেতাদের মধ্যে একই সঙ্গে আশঙ্কা ও উদ্দীপনা তৈরি হলো।
বিষয়টি কাতারের আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানিকে আলজাজিরার মতো একটি চ্যানেল প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৯৬ সালের পয়লা নভেম্বর প্রতিষ্ঠার পর থেকে চ্যানেলটিতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে কাতার।
প্রচার বাড়াতে শুরু থেকেই জনগণ পছন্দ করবে, এমন সব অনুষ্ঠান শুরু করে আলজাজিরা। এ বিষয়ে আরব গণমাধ্যমের ওপর একটি গ্রন্থের রচয়িতা শিবলী তেলহামি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আরবরা যেসব অনুষ্ঠানের জন্য মুখিয়ে ছিল, আলজাজিরা সেগুলো শুরু করে। যেমন : চ্যানেলটি ইসরায়েলিদের সঙ্গে ফিলিস্তিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সরাসরি সম্প্রচার করে। আরবের অন্য দেশের জাতীয় টেলিভিশনগুলো এতদিন এগুলো দেখায়নি।
চ্যানেলটি আরেকটি বাধা ডিঙ্গায় ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে প্রতিবেদক পাঠিয়ে। সেখান থেকে তারা পার্লামেন্টের বিতর্ক সরাসরি সম্প্রচার করে। ২০০৮ সালে গাজায় ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধে মাঠে সবচেয়ে বেশি রিপোর্টারকে কাজে লাগায় আলজাজিরা। এটিই ছিল একমাত্র চ্যানেল, যারা যুদ্ধ সরাসরি সম্প্রচার করে। এর আগে এ ধরনের কাজ করার সাহস দেখিয়েছে খুব কমসংখ্যক আরব চ্যানেল।
আলজাজিরা বিন লাদেনের অডিও টেপ, ইরানের রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার, ইরাক যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বক্তব্য ও সংবাদ সম্মেলন দেখানো, তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ডের বক্তব্য কভার করার মতো সাহস দেখিয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে চ্যানেলটির জনপ্রিয়তা ব্যাপক বাড়ে।
২০০১ সালে এসে আলজাজিরা সবচেয়ে বেশি দর্শকের আরব টেলিভিশন চ্যানেল হিসেবে পরিচিতি পায়। আর ২০০৬ সালে আরবদের ৭৫ শতাংশই আলজাজিরাকে তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় কিংবা দ্বিতীয় জনপ্রিয় চ্যানেল হিসেবে বিবেচনা করে।
ধারাবাহিকভাবে চ্যানেলটির সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনাও জুটে। ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর অনেক আমেরিকান চ্যানেলটিকে বিষোদগার তৈরির মাধ্যম হিসেবে মনে করেন। ২০১২ সালে আলজাজিরা ইংলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় চীন।
আলাদাভাবে পরিচালিত আলজাজিরা অ্যারাবিকের বিরুদ্ধে মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থনের অভিযোগ আছে। ‘দ্য আলজাজিরা অ্যাফেক্ট’ নামের বইয়ের লেখক হাগ মাইলস চ্যানেলটিকে ফক্স নিউজের সঙ্গে তুলনা করে। সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফকে মাইলস বলেন, আলজাজিরা অ্যারাবিক খুবই পক্ষপাতদুষ্ট এবং এটা ইসলামপন্থীদের সমর্থন করে।
উল্লিখিত বিষয়গুলো থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, আলজাজিরার ব্যাপক জনপ্রিয়তা অনেক ক্ষেত্রেই আরবদের স্বার্থসংঘাত বা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের কারণ হয়েছে। আর এ কারণেই চ্যানেলটি বন্ধ করতে চায় সৌদি আরব। সব ধরনের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে সৌদির নেতৃত্বাধীন জোটের চার আরব দেশ কাতারকে যে ১৩টি শর্ত দিয়েছে, তার অন্যতম আলজাজিরা বন্ধ করা।