আবেগি এক ভিডিও নিয়ে তর্ক জমেছে চীনে

একজন নারীকে বিয়ে করতে হবে ২৫ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে। চাকরি-বাকরি বা ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটতে গিয়ে তিনি যদি এই বয়সসীমা অতিক্রম করে ফেলেন, তাহলে তাঁকে ডাকা হবে ‘লেফটওভার উইমেন’। বাংলা করলে যার অর্থ অনেকটা দাঁড়ায় ‘উচ্ছিষ্ট নারী’।
কোনো পশ্চাৎপদ সমাজে নয়, এই নিয়ম প্রচলিত রয়েছে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার শীর্ষ দেশ চীনে।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীরা যখন এগিয়ে চলেছেন ঠিক সে সময় চীন নারীর জন্য ঠিক করে রেখেছে এমন অদ্ভুত নিয়ম। চীনের সমাজে বিয়ে এবং সন্তানধারণকেই নারীর জীবনের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শুধু বিয়ে না করার কারণে নানা ক্ষেত্রে চীনের মেয়েদের বেশ নিগৃহীত হতে হয়। অপমানিত হতে হয় তাঁদের বাবা-মাকেও।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতদিন বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য না হলেও সম্প্রতি চীনা ভাষায় নির্মিত একটি তথ্যচিত্র প্রচার হওয়ার পর সমস্যাটি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন সবাই। তথ্যচিত্রটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভাইরাল হয়েছে।
নারী ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিতে জাপানের সৌন্দর্য পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এস কে টু এই তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছে।
এ বিষয়ে এস কে টুর প্রধান বিবিসি অনলাইনকে বলেছেন, নারী যেন তাঁর নিজের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারেন সে লক্ষ্যে নারীর ক্ষমতায়নকে উৎসাহিত করতেই এই তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। সমাজের নানা চাপকে মোকাবিলা করতে নারীদের শক্তি জোগাতেই তাঁদের এই প্রয়াস বলে জানান তিনি।
লেফটওভার উইমেন কারা?
চীনের সরকারের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ২৭ বছরের বেশি বয়সী অবিবাহিত নারীরাই লেফটওভার উইমেন। চীনের ‘এক সন্তান’ নীতির কারণে লিঙ্গ অসমতা তৈরি হওয়ায় নীতিটি বাতিল করা হয়। আর এই অসমতা দূর করতেই চীনের নারীদের বিয়েতে উৎসাহী করতে চাইছে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকার।
অবশ্য তথ্যচিত্রটির লেখক লেতা হং ফিংচারের দাবি, চীনের সরকার স্বাধীন নারীদের নিজের মতো করে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে চাপ দিচ্ছে। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি লেখাপড়া শিখছে চীনের মেয়েরা। তারা এখন অনেক সাবলম্বী। স্বভাবতই তাদের ভেতর বিয়ে না করার প্রবণতা বাড়ছে।
হং ফিংচার বলেন, ভিডিওচিত্রটি জনপ্রিয় হওয়ার কারণ এখানে যা দেখানো হয়েছে তা ভীষণ বাস্তব। প্রত্যেকেই তাঁর দেখা জীবনগুলোর সঙ্গে ভিডিওটির মিল খুঁজে পেয়েছেন। সত্য কথাগুলোই শৈল্পিকভাবে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। এখানে বর্ণিত অবিবাহিত নারীরা প্রত্যেকেই দারুণভাবে তাঁদের জীবন উপভোগ করছেন। তবে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ার বিষয়টিও খুব সত্যি। চীনের বহু অবিবাহিত কর্মজীবী নারীর জীবনের এটাই সত্যি।
অবিবাহিত নারী অপূর্ণ
ভিডিওচিত্রটিতে নারীরা বলেছেন যে একাকী জীবন কাটাতে বা ২৭-এর পরেও বিয়ে না করে থাকতে তাঁদের কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সেখানে এক নারীকে কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে বলতে শোনা যায়, ‘চীনা সংস্কৃতিতে অভিভাবকদের সম্মান করাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এবং বিয়ে না করাটা তাঁদের অসম্মান করার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত।’
আরেক নারী বলেন, ‘সবাই মনে করে চীনা সমাজে অবিবাহিত নারী মানেই অসম্পূর্ণ মানুষ।’
এদিকে বিয়ে না করলে বা বিয়ে না হওয়াকে চীনা বাবা-মায়েরা তাঁদের মেয়ের অযোগ্যতা বলে মনে করেন। এমনই এক বাবা-মা ক্যামেরার সামনে বলেন, ‘আমরা সব সময়ই ভাবতাম আমাদের মেয়ের ব্যক্তিত্ব দারুণ। কিন্তু সে খুব সাধারণ দেখতে, খুব সুন্দরী নয়। আর এ কারণেই সে লেফটওভার উইমেনে পরিণত হয়েছে।’ এ সময় পাশে বসে থাকা মেয়েটিকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়।
এস কে টু ব্র্যান্ডের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত এই ভিডিওটি দেখা হয়েছে প্রায় আট লাখ বার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে দারুণ সাড়া পেয়েছে ভিডিওটি। এ ছাড়া এই ভিডিওকে ঘিরে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও শুরু হয়েছে।
লোটাস সিড নামে এক নেটিজেন ভিডিওটি শেয়ার করে বলেছেন, ‘একটি সভ্য সমাজের উচিত প্রতিটি নারীর মতকে সম্মান করা।’
সিসিলিয়া লিউং নামে এক চীনা নারী লিখেছেন, ‘আমি একজন অবিবাহিত নারী। আমি এই ভিডিওটি দেখতে চাই। নিজেকে এটা জানাতে চাই যে আমি একা নই এবং আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা ভুল ছিল না। একজন নারী তাঁর জীবনে পুরুষের উপস্থিতি ছাড়াও সুখে থাকতে পারে। আমরা জীবনে যা বেছে নিয়েছি, তার জন্য শাস্তি পাওয়া উচিত নয়।’
ভিডিওচিত্রটির শেষটা হয়েছে দারুণ ইতিবাচকভাবে। সেখানে দেখা যায়, অবিবাহিত নারী এবং তাঁদের অভিভাবকরা ‘বিয়ে বাজারে’ ঘুরতে যান। সাধারণত এই বাজারে অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানদের সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে পোস্টারের মতো করে টাঙিয়ে রাখেন, যা দেখে অন্যরা তাঁদের সন্তানদের জন্য পাত্রপাত্রী খুঁজে নেন।
তবে এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিয়ের বাজারে বাবা-মায়েদের জন্য ইতিবাচক বার্তা দিয়ে নিজেদের ছবি টাঙিয়ে রেখেছেন মেয়েরা। আর তা দেখে আপ্লুত হন অভিভাবকরা।
একটি পোস্টারে দেখা যায়, একজন নারী তাঁর বাবা-মায়ের উদ্দেশে বলছেন, ‘শুধু বিয়ে করতে হবে বলে আমি বিয়ে করতে চাই না। ও রকম হলে আমি সুখী হব না।’
আরেকজন লিখেছেন, ‘লেফটওভার উইমেন এই শব্দটারই তীব্র বিরোধিতা করি আমি।’
তবে এই ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে আসলেই কি চীনের নারীদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসবে? এমন প্রশ্নের জবাবে হং ফিংচার বলেন, ‘এই মুহূর্তে সেটা আশা করা হবে স্বপ্নের মতো। তবে একসময় এটা বাস্তব হবে এবং চীনের মেয়েরা স্বাধীনভাবে একা জীবন কাটাবেন বলেই আমি আশা করি।’