বিশ্বে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার ৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ

পুরো বিশ্বে গত বছর এক রেকর্ড সংখ্যক মানুষ তাদের নিজ দেশের ভেতরেই গৃহহীন হয়েছে। ২০২৪ সালে এই অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৮ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছেছে, যা জার্মানির মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান। তবে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ কোনো আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরোয়নি বা দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যায়নি। বরং সংঘাত, সহিংসতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নিজেদের ভিটেমাটি, গ্রাম বা শহর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।
ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার (আইডিএমসি) ও নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি)-এর যৌথভাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ছয় বছরে বিশ্বজুড়ে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
আইডিএমসি-এর প্রধান আলেক্সান্দ্রা বিলাক এই পরিস্থিতিকে এক জটিল সংকট হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেখানে সংঘাত, দারিদ্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্মিলিতভাবে আঘাত হানে। তিনি আরও বলেন, এর সবচেয়ে বড় শিকার হয় দরিদ্র, দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
প্রতিবেদন অনুসারে, বাস্তুচ্যুতদের প্রায় ৯০ শতাংশ, অর্থাৎ ৭ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ সংঘাত ও সহিংসতার কারণে ঘরছাড়া হয়েছে। এই সংখ্যা ২০১৮ সালের তুলনায় প্রায় ৮০ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ, সংঘাত ও সহিংসতার কারণে অন্তত ১০টি দেশের প্রতিটিতে তিন মিলিয়নেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে, যার মধ্যে দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ কবলিত সুদানের পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। দেশটিতে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১৬ লাখে পৌঁছেছে, যা একক কোনো দেশে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
অন্যদিকে, গত বছরের শেষের দিকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, যা ওই অঞ্চলের প্রায় সমগ্র জনসংখ্যার সমান। এরপর চলতি বছরের মার্চে ইসরায়েল নতুন করে হামলা শুরু করলে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।
২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে মোট ছয় কোটি ৫৮ লাখ মানুষ নতুন করে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই একাধিকবার স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রায় এক কোটি মানুষ নিজ দেশে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যা আগের পাঁচ বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। সংঘাত ও সহিংসতার কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ছিল দুই কোটি এক লাখ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত চার কোটি ৫৮ লাখ মানুষ এক বছরে দুর্যোগজনিত বাস্তুচ্যুতির নতুন রেকর্ড তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে হেলেন ও মিল্টনের মতো শক্তিশালী হ্যারিকেনের কারণে প্রায় এক কোটি মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়, যা বৈশ্বিক মোট দুর্যোগজনিত বাস্তুচ্যুতির চার ভাগের এক ভাগ। ২০২৪ সালের দুর্যোগজনিত বাস্তুচ্যুতির ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশই ছিল আবহাওয়া সম্পর্কিত, যার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের সুস্পষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
পরিসংখ্যান আরও দেখায়, গত ১৫ বছরে এমন দেশের সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে, যেখানে একই সঙ্গে সংঘাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। সংঘাতজনিত বাস্তুচ্যুতদের প্রায় চার ভাগের তিন ভাগই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর নাগরিক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস্তুচ্যুতির কারণ ও প্রভাব প্রায়শই একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত, যা সংকটকে আরও জটিল করে তোলে এবং বাস্তুচ্যুতদের দুর্ভোগ দীর্ঘস্থায়ী করে।
এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান এমন এক সময়ে প্রকাশিত হলো, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক মানবিক সহায়তার একটি বড় অংশ বন্ধ করে দিয়েছেন, যার সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাস্তুচ্যুতদের ওপর।
এনআরসি প্রধান ইয়ান এগেল্যান্ড এই তথ্যকে ‘ঘুম ভাঙানোর জন্য যথেষ্ট’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, প্রতিবার যখন মানবিক সহায়তার তহবিল কমে যায়, তখন অসংখ্য বাস্তুচ্যুত মানুষ তাদের খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হয়।
বাস্তুচ্যুত এই বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের দেশ ত্যাগ না করেও নিজ রাষ্ট্রের সীমানার ভেতরেই আশ্রয়হীন, সুবিধাবঞ্চিত ও উপেক্ষিত উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই বিশাল সংকট সত্ত্বেও তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সহায়তা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এই পরিস্থিতি কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং নীতিনির্ধারকদের জন্য এক চরম সতর্কবার্তা এবং মানবতার কাছে এক গভীর দায়বদ্ধতার প্রশ্ন।