রঙে আঁকা ভবিষ্যদ্বাণী : কল্পনার ভূকম্পে বাস্তবিক আতঙ্ক

কল্পনার ভূকম্পে বাস্তবিক আতঙ্ক। জাপানের একটি জনপ্রিয় মাঙ্গা (জাপানি ভাষায় তৈরি গ্রাফিক উপন্যাস বা কমিক বই) থেকে আসা ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী বর্তমানে দেশটির জনসাধারণের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এর ফলস্বরূপ, জাপানের পর্যটন শিল্পেও এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে, বিশেষ করে এশিয়ার কয়েকটি প্রধান দেশ—দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও হংকং থেকে জাপান ভ্রমণের ফ্লাইট বুকিংয়ের হার আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান এমন খবর দিয়েছে।
রয় তাতসুকির ‘দ্য ফিউচার আই স্য’ মাঙ্গা ও ভবিষ্যদ্বাণী
লেখিকা রয় তাতসুকির ‘দ্য ফিউচার আই স্য’ নামের মাঙ্গাটি তার নিজের ভবিষ্যদ্বাণীমূলক স্বপ্নের ওপর ভিত্তি করে লেখা। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত এই মাঙ্গাটির প্রচ্ছদে ২০১১ সালের মার্চে একটি ভয়াবহ দুর্যোগ সংঘটনের ইঙ্গিত ছিল। কাকতালীয়ভাবে, এ সময়েই জাপানে স্মরণকালের বিধ্বংসী ভূমিকম্প ও সুনামি আঘাত হানে, যার ফলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ১৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন। এছাড়া ফুকুশিমার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জনজীবনে বিপর্যয় নেমে আসে।
পরবর্তীতে, মাঙ্গাটির ২০২১ সালে প্রকাশিত নতুন সংস্করণে নির্মাতা তাতসুকি আরও পূর্বাভাস দেন– পরবর্তী ভয়াবহ দুর্যোগটি ২০২৫ সালের ৫ জুলাই ঘটবে।
বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীনতা সত্ত্বেও জনমনে উদ্বেগ
এই দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবে, ২০১১ সালের দুর্যোগ নিয়ে লেখিকার পূর্বাভাস মিলে গিয়েছিল বলে তার সাম্প্রতিক পূর্বাভাস সামাজিকমাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় এসেছে। বিষয়টি অনেকেই গুরুত্বসহকারে নিচ্ছেন, যার কারণে সাধারণ মানুষ ও পর্যটকদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে জাপানের পর্যটন খাতে, বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও হংকং থেকে জাপানগামী পর্যটকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে।
বিমান বুকিং বিশ্লেষণকারী সংস্থা ফরোয়ার্ডকিইসের তথ্য ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অর্থনৈতিক গবেষণা ও বাজার বিশ্লেষণকারী সংস্থা ব্লুমবার্গ ইন্টেলিজেন্স জানিয়েছে, হংকং থেকে জাপানগামী ফ্লাইট বুকিং গত বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ কমেছে। চলতি বছরের জুনের শেষ থেকে জুলাইয়ের শুরু পর্যন্ত সময়কালের বুকিং ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।
হংকংয়ের একটি পর্যটন সংস্থা (ট্র্যাভেল এজেন্সি) জানিয়েছে, ওই মাঙ্গার প্রভাবেই অনেকেই জাপান সফরের পরিকল্পনা বাতিল করছেন। এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া বসন্তকালীন ছুটির সময়ে জাপানগামী পর্যটক সংখ্যা এরমধ্যেই গত বছরের অর্ধেকে নেমে এসেছে। হংকংভিত্তিক বিমান সংস্থা গ্রেটার বে এয়ারলাইন্স জানিয়েছে, চেরি ফুলের মৌসুম ও ইস্টার ছুটিকে কেন্দ্র করে সাধারণত জাপানে ভ্রমণের চাহিদা বেশি থাকলেও এবার তা আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে।
জাপানে সংস্থাটির কান্ট্রি ম্যানেজার হিরোকি ইতো স্থানীয় গণমাধ্যম আসাহি শিম্বুনকে বলেন, ‘আমরা ধারণা করেছিলাম এবারের মৌসুমে বিমানের আসনের প্রায় ৮০ শতাংশ বুক হয়ে যাবে। অথচ বাস্তবে হয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ।’ এ অবস্থায় গ্রেটার বে এয়ারলাইন্স ও হংকং এয়ারলাইন্স জাপানের ফ্লাইটের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে।
সরকারের আহ্বান ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
এদিকে, জাপান সরকার এই গুজব এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছে। দেশটির মিয়াগি প্রদেশের গভর্নর ইয়োশিহিরো মুরাই, যা ২০১১ সালের ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি অঞ্চলের অন্যতম, তিনি এ ধরনের গুজবের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘এসব ভিত্তিহীন দাবি পর্যটনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আমরা সবাইকে অনুরোধ করছি—গুজবে কান না দিয়ে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিন।’
কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে জাপানে পর্যটকের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এপ্রিল মাসে রেকর্ড ৩৯ লাখ পর্যটক দেশটিতে ভ্রমণ করেছেন। সরকার আশা করছিল, চলতি দশকের শেষে দেশটির বার্ষিক পর্যটক সংখ্যা ছয় কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
দেশটির সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকে জানিয়েছে, ২০২১ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে মাঙ্গাটির নতুন সংস্করণের প্রায় ১০ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে ইউটিউবে এক হাজার ৪০০টিরও বেশি ভিডিও আপলোড করা হয়েছে, যেগুলো এরমধ্যেই ১০০ কোটিরও বেশি বার দেখা হয়েছে। কিছু ভিডিওতে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ এমনকি উল্কাপাতের মতো আতঙ্কজনক পূর্বাভাসও দেওয়া হয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরের ‘রিং অব ফায়ার’ এলাকায় অবস্থিত হওয়ার কারণে জাপান পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্প প্রবণ দেশ। ‘রিং অব ফায়ার’ হলো প্রশান্ত মহাসাগর ঘিরে বিস্তৃত ভূকম্পন ও আগ্নেয়গিরিপ্রবণ একটি অঞ্চল, যেখানে পৃথিবীর অধিকাংশ শক্তিশালী ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের সময় ও স্থান সঠিকভাবে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়।
অতীতের সতর্কতা ও বর্তমান বাস্তবতা
গেল আগস্টে ভূকম্পবিদদের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে মেগা ভূমিকম্পের সতর্কবাণীতে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা একটি বিদেশ সফর বাতিল করেছিলেন। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশটির একটি সরকারি টাস্কফোর্স আশঙ্কা করেছে, নানকাই ট্রাফ এলাকায় ৯ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। এতে, প্রায় দুই লাখ ৯৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি ও ২০ লাখেরও বেশি স্থাপনা ধ্বংস হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাদের মতে, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে এমন দুর্যোগ ঘটার সম্ভাবনা প্রায় ৮০ শতাংশ।
অন্যদিকে, মাঙ্গার নির্মাতা তাতসুকি নিজেই তার পূর্বাভাসগুলো বিশ্বাস না করার জন্য পাঠকদের সতর্ক করেছেন। দেশটির গণমাধ্যমে দেওয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমার লিখা মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপারে সচেতন করেছে, এটা আনন্দের বিষয়। তবে অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রভাবিত না হয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত শোনা গুরুত্বপূর্ণ।’