অবতরণ

নীল আকাশের বিশাল গম্বুজ। তার নিচে সূর্যের আলো ঝরে পড়ছে। দেখে মনে হবে যেন গলিত সোনার ধারা। সকালের বাতাসে শিশিরের গন্ধ মাখা। দূরের জঙ্গলে কোকিল কুহু ডাকছে আর তৃণভূমির ওপর খেলা করছে সোনালি আলো। সেই আলোয় ডানা মেলে উড়ছে এক পাখি। ছোট্ট অথচ সাহসী। বাতাসের বুকে ডানা মেলতে মেলতে সে অনুভব করছে মুক্তির স্বাদ। যেন পৃথিবীর কোনো শক্তি তাকে আটকে রাখতে পারবে না।
উড়তে উড়তে তার চোখে প্রথম ধরা দিলো পাহাড়। বিশাল, অটল, যেন অনন্ত সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর বুকের ওপর। পাখি বিস্ময়ে তাকালো, বিস্ময়ের সঙ্গে বুকের ভেতর কিছু একটা জেঁকে বসলো। মনে হলো, ‘আমি তো এর থেকেও শক্তিশালী। পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে স্থির হয়ে, আর আমি তো এর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি। পাহাড় যতই উঁচু হোক, আমার ডানায় যে আকাশের সীমাহীন স্বাধীনতা।’
পাহাড় পেছনে পড়ে রইলো, সামনে উদিত হলো সাগর। অসীম নীল, ঢেউয়ের গর্জন, আর অস্থির জলরাশি। সাগরের বুক যেন একেকটি বিস্ফোরিত হৃদস্পন্দনের মতো দুলছে, ফুঁসে উঠছে অবিরাম। পাখি সেই সাগরের ওপরে উড়ে চললো, ঢেউয়ের উন্মত্ততা উপেক্ষা করে। মনে মনে সে আবার গর্ব করলো, ‘আমি তো সাগরের ওপরে। ঢেউ আমাকে ছুঁতে পারে না। আমি তো সাগরের থেকেও উঁচু, সাগরের থেকেও শক্তিশালী।’
তারপর দূরে দেখা দিলো আগ্নেয়গিরি। কালো শিলার বুক ফুঁড়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে, মাঝে মাঝে আগুন ঝলসে উঠছে যেন আকাশকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। পৃথিবীর অগ্নিময় অন্তরাকে পাখি দেখলো বিস্ময়ে। কিন্তু তবুও তার বুক ভরলো গর্বে। সে ভাবলো, ‘আমি তো এই ধোঁয়ার থেকেও উপরে উড়তে পারি। আগুন আমার নাগাল পায় না। আমি তো আগ্নেয়গিরির থেকেও শক্তিশালী।’
সময় গড়ালো, সূর্য আরও উঁচুতে উঠলো। বাতাসে তাপ বাড়লো। পাখির ডানা ভারী হয়ে এলো, বুক ধকধক করতে লাগলো। শক্তি ক্ষয় হতে থাকলো। তখনই সে বুঝলো, শুধু আকাশে উড়ে চলা এক চিরন্তন সত্য নয়। শরীর যেমন ক্লান্ত হয়, তেমনি ডানা একসময় আর বহন করতে পারে না ভ্রমের ওজন।
ক্লান্ত পাখি ধীরে ধীরে নেমে এলো মাটির কাছাকাছি। তার গলা শুকিয়ে কাঠ, তৃষ্ণায় চোখ ঝাপসা। হঠাৎ সে দেখতে পেলো পাহাড়ের পাদদেশে নদী বয়ে যাচ্ছে। টলমল স্বচ্ছ জল, যার ওপর সূর্যের আলো রূপালি ঝিলিক তুলছে। পাখি আনন্দে উড়তে উড়তে নদীর কাছে এলো। কিন্তু সে যখন বসতে গেলো, তখন নদীর প্রচণ্ড ঢেউ তাকে জায়গা দিলো না। স্রোতের আঘাত তাকে ছিটকে দিলো দূরে। নদী যেন বললো, ‘আমাকে জয় করা সহজ নয়, ছোট্ট উড়ন্ত প্রাণ।’
বিক্ষুব্ধ জলে দাঁড়াতে না পেরে পাখি চোখ তুললো পাহাড়ের চূড়ার দিকে। কত উঁচু, কত মহিমান্বিত! কিন্তু তার চোখ সেখানে স্থির হতে পারলো না। মাথা ঘুরে গেলো, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। তখনই তার মনে পড়লো আগ্নেয়গিরির আগুন, সাগরের গর্জন, পাহাড়ের দৃঢ়তা। কত ছোট, কত ক্ষণস্থায়ী তার এই ডানার অহঙ্কার!
সে থমকে গেলো। মনে হলো, এতক্ষণ সে প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করেছে। ভেবেছে তার ডানার ঝাপটা পাহাড়ের দৃঢ়তা, সাগরের বিস্তৃতি, আগ্নেয়গিরির তেজের চেয়ে শক্তিশালী। অথচ প্রকৃতি এক মুহূর্তেই তাকে বোঝালো, সে কেবলমাত্র ক্ষুদ্র এক প্রাণ, যার শক্তি সীমিত, যার জীবনও ক্ষণিকের।
আকাশ তখন গভীর নীল থেকে বেগুনির দিকে ঢলে পড়ছে। গোধূলির মায়াবী রঙ আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। পাহাড়ের গায়ে লাল আলো ঝরে পড়ছে, সাগরের ঢেউ সোনালি আভায় ঝলমল করছে। দূরে আগ্নেয়গিরি ধোঁয়া ছড়াচ্ছে, কিন্তু সেই ধোঁয়ার ভেতরেও যেন অদৃশ্য কবিতা লেখা আছে—প্রকৃতির শক্তি, ধৈর্য আর মহিমার কবিতা।
পাখি সেই দৃশ্যের সামনে চুপ করে গেলো। ডানা গুটিয়ে বসে রইলো মাটির কাছাকাছি এক শুষ্ক পাথরের ওপর। বুক ভরে শ্বাস নিলো, আর মনে মনে স্বীকার করলো, ‘আমি শক্তিশালী নই, আমি কেবল প্রকৃতির সন্তান। পাহাড়, সাগর, আগ্নেয়গিরি—সবাই মিলে যে মহিমা তৈরি করেছে, তার ভেতরেই আমি ক্ষুদ্র এক সুর, ক্ষুদ্র এক প্রাণ।’
সেই মুহূর্তে পাখির অহঙ্কার ভেঙে গলে গেলো বিনয়ে। প্রকৃতির বিশালতার সামনে তার মাথা নত হলো। আর বাতাসে তখন ভেসে বেড়াচ্ছিল প্রকৃতির নিজস্ব সুর—যেখানে প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি আগুনের শিখা, প্রতিটি পাহাড়ের পাথর, এমনকি পাখির ক্ষুদ্র ডানার ঝাপটাও মিলেমিশে রচনা করছে অনন্ত জীবনের সঙ্গীত।