কারাগারে ‘মানবতার দেয়াল’

‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’—এ স্লোগান দেশের সব কারাগারের প্রধান ফটকে চোখে পড়ে। কারাগার হচ্ছে অপরাধীদের সাজা ভোগের স্থান। এখন সংশোধনাগারও বলা হয়ে থাকে। যেখানে প্রকৃতপক্ষে মানবতা বা সহানুভূতির বড়ই অভাব। যদিও এ ধারণা পাল্টে দিতে কারাগারগুলোকে আধুনিকায়নের জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
এরই ধারাবাহিকতায় খুলনা জেলা কারাগার এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। এ কারাভ্যন্তরে স্থাপন করা হয়েছে ‘মানবতার দেয়াল’। এ দেয়ালের মাধ্যমে বন্দিদের কারো অপ্রয়োজনীয় পোশাক বা কাপড় অন্য বন্দির প্রয়োজন মেটানোর সুযোগ তৈরি করেছে। যা শুধু খুলনা বিভাগেই নয়, সারা দেশের কারাগারের মধ্যেও প্রথম উদ্যোগ। কর্তৃপক্ষ পর্যায়ক্রমে এ উদ্যোগ বিভাগের অন্য কারাগারগুলোতেও ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে।
জেলা কারাগার সূত্রে জানা যায়, বন্দিদের সংশোধন, তাদের মধ্যে মানবিক গুণাবলি এবং সর্বোপরি সামাজিক দায়িত্ববোধ তৈরির লক্ষ্যেই খুলনা জেলা কারাভ্যন্তরে ‘মানবতার দেয়াল’ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। নভেম্বরের শেষের দিকেই এ কার্যক্রম শুরু করা হয়। ৫ ডিসেম্বর খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। এ সময় জেলা কারাগার সুপার (তত্ত্বাবধায়ক) মো. কামরুল ইসলাম ও জেলার মো. জান্নাতুল ফরহাদ উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, কারাগারে এমন অনেক বন্দি আছেন, যাঁরা খুবই দরিদ্র-অসহায়। একই পোশাক পরেই তাঁদের দিনের পর দিন কাটাতে হয়। কিন্তু কারো কাছে হাত পাততে পারেন না। আবার অনেকেই আছেন, যাঁরা ধনী, সচ্ছল। যাঁদের কাছে নিত্যনতুন পোশাকের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হয় না। মূলত এ দুটি শ্রেণির মধ্যে সমতা ও পরস্পরের মধ্যে সহানুভূতি তৈরির লক্ষ্যেই ‘মানবতার দেয়াল’ স্থাপন করা হয়েছে। সচ্ছল বন্দিরা তাঁদের অপ্রয়োজনীয় কাপড় কী করবেন, কাকে দেবেন—এ বিষয়ে চিন্তিত না হয়ে অনায়াসেই সেগুলো ‘মানবতার দেয়াল’-এ ঝুলিয়ে রাখছেন। আবার যাঁদের প্রয়োজন, তাঁরা সেখান থেকে নিয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে কাউকে বলা বা কারো কাছ থেকে কোনো ধরনের অনুমতি নেওয়ারও দরকার হচ্ছে না। এতে অনেকেরই প্রয়োজন মিটছে।
খুলনা কারাগারের জেলার মো. জান্নাতুল ফরহাদ বলেন, কারাগারের ভেতরে একটি টিনের শেডের নিচে কিছু জায়গায় টাইলস লাগিয়ে ‘মানবতার দেয়াল’ স্থাপন করা হয়েছে। যাতে এসএমের রড ও স্ট্যান্ড বসানো হয়েছে। এ দেয়ালের এক প্রান্তে ‘আপনার অপ্রয়োজনীয় কাপড় এখানে রাখুন’ এবং অপর প্রান্তে ‘আপনার প্রয়োজনীয় কাপড় এখান থেকে নিয়ে যান’ লিখে রাখা হয়েছে। বন্দিরাও এতে সাড়া দিয়ে কেউ কেউ কাপড় রেখে যাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ নিয়ে যাচ্ছেন।
খুলনা জেলা কারাগারের সুপার (তত্ত্বাবধায়ক) মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই কারাভ্যন্তরে এ কার্যক্রম শুরু করা হয়। বিষয়টিতে বন্দিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছে এবং তাঁদের মধ্যে এক ধরনের মানবতাবোধও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
কারা অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় সদর দপ্তরের ডিআইজি প্রিজন ছগির মিয়া খুলনা কারাগারের ‘মানবতার দেয়াল’ স্থাপনের উদ্যোগের প্রশংসা এবং স্বাগত জানিয়ে বলেন, কয়েক মাস আগে তাঁর সঙ্গে এ উদ্যোগের বিষয়ে খুলনা কারাগারের কর্মকর্তারা আলোচনা করেন। তখনই তিনি এ বিষয়ে সম্মতি দেন। সেভাবেই কাজটি করা হয়েছে। এটি দেশের মধ্যে প্রথম উদ্যোগ।
ডিআইজি প্রিজন ছগির মিয়া আরো বলেন, ‘এটি আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে, এটি একটি মহতী উদ্যোগ। কারাগারগুলোকে সংশোধনাগারে রূপান্তর সরকারের সিদ্ধান্তেরই একটি অংশ।’ ইনোভেশনমূলক এ উদ্যোগের কারণে খুলনা কারাগারকে ‘মডেল’ হিসেবে নিয়ে পর্যায়ক্রমে খুলনা বিভাগের অন্যান্য কারাগারেও ছড়িয়ে দিতে চান বলেও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।
১৯১২ সালে ভৈরব নদের তীরে খুলনা জেলা কারাগার নির্মাণ করা হয়। ৬০৮ জন বন্দি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন কারাগারে প্রায়ই দুই থেকে তিন গুণ বেশি বন্দি থাকে। এর কয়েকটি ভবনও পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এ কারণে খুলনা বাইপাস সড়কের পাশে ৩০ একর জমিতে প্রায় দুই হাজার বন্দি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন নতুন ও আধুনিক কারাগারের নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় কারাগারের উপযোগী জনবলও বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে ডিআইজি প্রিজনের দপ্তরও যশোর থেকে খুলনায় স্থানান্তর করা হবে বলেও সূত্র জানিয়েছে।