ক্রিকেট জুয়ায় রাজশাহীতে প্রিমিয়ার ব্যাংকের সাড়ে ৩ কোটি টাকা উধাও

অনলাইন ক্রিকেট জুয়ায় জড়িয়ে ব্যাংকের ক্যাশ উজাড় করে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে প্রিমিয়ার ব্যাংক রাজশাহী শাখার ক্যাশ ইনচার্জ শামসুল ইসলাম ফয়সালকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। বুধবার নিজের অপরাধ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ক্যাশ অফিসার। ক্রিকেট জুয়া এবং টাকা আত্মসাতের সাথে আরো কেউ জড়িত আছে কি না, তা উদঘাটনে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে অনলাইনে জুয়া খেলার জন্যই প্রিমিয়ার ব্যাংকের ভল্ট থেকে তিন কোটি ৪৫ লাখ টাকা আত্মসাত করেছিলেন জানিয়ে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে শামসুল ইসলাম ফয়সাল বলেছেন, জুয়া খেলে এই টাকা তিনি হেরেছেন। মহানগর মুখ্য হাকিম আদালত ২-এর বিচারক মো. সাদেকীন হাবীব বাপ্পী বুধবার বিকেল পৌনে ৪টা থেকে সোয়া ৪টা পর্যন্ত ফায়সালের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন বলে জানান বোয়ালিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিবারণ চন্দ্র বর্মণ।
এর আগে গত শুক্রবার প্রিমিয়ার ব্যাংকের রাজশাহী শাখার জোনাল ম্যানেজার সেলিম রেজা খান বাদী হয়ে তিন কোটি ৪৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযাগে বোয়ালিয়া মডেল থানায় ক্যাশ ইনচার্জ শামসুল ইসলাম ফয়সালের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই দিন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। সোমবার আদালত থেকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে পুলিশ থানায় নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
এদিকে, টাকা আত্মসাতের ঘটনা তদন্তে এরই মধ্যে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় থেকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ্ আলমের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত টিম রাজশাহীতে এসে তদন্ত কাজ শুরু করেছে। তদন্ত কমিটির প্রধান উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ্ আলম জানান, এই টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ফয়সাল একাই নাকি ব্যাংকের আরো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত রয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে ভল্টে টাকা সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় অন্তত দুজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর থাকে। এ ক্ষেত্রে কী হয়েছে তাও দেখা হচ্ছে।
ব্যাংক সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক লেনদেন শেষে ক্যাশ ব্যালান্সে তিন কোটি ৪৫ লাখ টাকা ঘাটতির বিষয়টি ধরা পড়ে। এর পরই শামসুল ইসলাম ফয়সালকে আটক করে টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তা সম্ভব না হওয়ায় শুক্রবার ভোরের দিকে তাকে বোয়ালিয়া মডেল থানায় হস্তান্তর করে মামলা করেন ব্যাংক ম্যানেজার।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, ফয়সাল ব্যাংকের টাকা দিয়ে নিজের নামে সুবর্ণভূমি আবাসিক এলাকায় প্লট ও বাকি টাকা দুই বন্ধুকে ধার দিয়েছেন বলে প্রথমে জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেছেন প্রায় দুই বছর আগে বিট-৩৬৫ অ্যাপসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জুয়াড়ি চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা নিয়ে তিনি জুয়া খেলে হেরেছেন। ফয়সাল পুলিশকে জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকেই ক্রিকেটের অনলাইন জুয়ায় ব্যাংকের ক্যাশ দিয়ে ডলার করে জুয়া খেলতেন তিনি। খেলা শুরুর এক মাসের মধ্যে তিনি ব্যাংকের ক্যাশ থেকে কোটি টাকা খুইয়ে ফেলেন। ২০১৯ সালে একইভাবে হারিয়েছেন আরো দুই কোটি টাকা। ভারতের মুম্বাই ও দিল্লিভিত্তিক বিট-৩৬৫ নামের একটি অ্যাপসের মাধ্যমে জুয়ায় অংশ নিয়ে এই টাকা তিনি অনলাইনে পেমেন্ট করেছেন। ব্যাংকের ক্যাশ থেকে সরাসরি ডলার হয়ে অনলাইন ক্রিকেট বেটিং চক্রের হিসাবে ঢুকে পড়েছে এই টাকা।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ফয়সাল বলেছেন, প্রিমিয়ার ব্যাংকের রাজশাহী শাখার ভল্টে সব সময় প্রায় ১৫ কোটি টাকা থাকত। টাকা রাখার ভল্টের সামনের লাইন ঠিক রেখে পেছনের লাইন থেকে তিনি টাকাগুলো সরাতেন। এতে ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার সন্দেহ হতো না। ক্যাশ ইনচার্জ হিসেবে তিনিই দৈনিক টাকার হিসাব রাখতেন। খাতা-কলমে টাকার কোনো গরমিল ছিল না।
বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মণ জানান, গত ২৩ জানুয়ারি ভল্টের সব টাকা গণনার পর তিন কোটি ৪৫ লাখ টাকা কম পাওয়া যায়। এসময় ফয়সাল টাকা সরানোর কথা স্বীকার করেন।
ফয়সাল নগরীর সাগরপাড়া এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে। নগরীর একটি বড় কোচিং সেন্টারের শেয়ার হোল্ডারও তিনি। রাজশাহী কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স করা ফয়সালের নগরীতে একটি কোচিং সেন্টার রয়েছে। যার চারটি শাখাও রয়েছে। সেখান থেকে ফয়সাল বছরে এক থেকে দেড় কোটি টাকা আয় করতেন। সেই টাকার বেশিরভাগই তিনি অনলাইন ক্রিকেট জুয়ায় শেষ করেছেন। এদিকে পুলিশ ফয়সালের বাবা ও স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, ফয়সাল চাকরিতে যে বেতন পান তার কোনো টাকা পরিবারে দিতেন না।