সাহেদকে ধরতে সিলেট-মৌলভীবাজারে অভিযান
সিলেট বিভাগে অবস্থান করছেন রিজেন্ট হাপাতালের মালিক মো. সাহেদ এবং সিলেট বিভাগের যেকোনো সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে পারেন, এমন সম্ভাবনায় তৎপরতা শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সিলেট নগরীর পাঠানপাড়ায় অবস্থিত সাহেদের শ্বশুরবাড়িকেও নজরদারিতে রেখেছে তারা।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় সাহেদ অবস্থান করছে এমন গুঞ্জনে তৎপর হয়ে উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জেলার কুলাউড়া উপজেলার চাতলাপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে যেতে পারেন সন্দেহে কমলগঞ্জের শমশেরনগরে আকস্মিক পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়। আজ সোমবার সন্ধ্যা থেকে শমশেরনগর চৌমুহনা থেকে ভারতের ত্রিপুরাগামী সড়কের মুখে শমশেরনগর পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা দাঁড়িয়ে যানবাহন তল্লাশি শুরু করেন। সেইসঙ্গে কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন রেস্ট হাউজে অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
শমশেরনগর পুলিশ ফাঁড়ি সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ থেকে তাদের জানানো হয়েছে রিজেন্ট হাসপাতালের করোনা কেলেঙ্কারির পলাতক প্রধান আসামি সাহেদ কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর সীমান্ত পথে ভারতের ত্রিপুরা যেতে পারেন। তাই সতর্কতা হিসেবে পুলিশ সদস্যদের যানবাহন তল্লাশি চলছে।
সোমবার বিকেল থেকে সতর্ক অবস্থানে থাকার পর সন্ধ্যা থেকে শমশেরনগর পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক আনজির হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল শমশেরনগর চৌমুহনায় দাঁড়িয়ে যানবাহনগুলো তল্লাশি শুরু করেন।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, সাহেদের মুঠোফোন ট্র্যাক করে দেখা গেছে তিনি মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থান করছেন। সর্বশেষ তাঁর অবস্থান ছিল কমলগঞ্জের শমশেরনগরে। তাই সোমবার বিকেল থেকে শমশেরনগর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলায় পুলিশি তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়।
শমশেরনগর পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক (তদন্ত) অরুপ কুমার চৌধুরী বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানা গেছে মো. সাহেদ চাতলাপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা প্রবেশ করতে পারেন। তাই তাঁকে ধরার জন্য সতর্কতামূলক তদারকি চালাচ্ছে পুলিশ। সোমবার রাত পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের শমশেরনগর চৌমুহনায় দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
এদিকে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদের বিরুদ্ধে দুইটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। আজ সোমবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাইনুল ইসলাম এই আদেশ দেন।
নথি থেকে জানা গেছে, রাজধানীর কারওয়ান বাজারে রড, ইট, সিমেন্টের ব্যবসায়ী মেসার্স মাসুদ এন্টারপ্রাইজের মালিক সাইফুল্লাহ মাসুদ ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেন। তাঁর কাছ থেকে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সাহেদ দুই কোটি ৫৮ লাখ ৩০ হাজার ৫৫ টাকার রড, সিমেন্ট, ইট ক্রয় করেন সাহেদ। তিনি কিছু টাকা পরিশোধ করলেও অনেক টাকা বাকি থাকে। পরবর্তীতে একইভাবে এক কোটি টাকার রড, ইট, সিমেন্ট নেন সাহেদ। এই এক কোটি টাকার জন্য সাহেদ চারটি ব্যাংক চেক দেন। কিন্তু চারটি চেক ব্যাংক প্রত্যাখ্যান করে। তারপর সাইফুল্লাহ মাসুদ টাকা চান। কিন্তু সাহেদ টাকা দেননি। বরং ভয়ভীতি দেখান ও হত্যার হুমকি দেন।
এ নিয়ে গত বছরের ৩ মার্চ মাসুদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর লিখিতভাবে অভিযোগ জানান। পরবর্তীতে, এ ব্যাপারে চলতি বছরের ৮ জুলাই উত্তরা পশ্চিম থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন সাইফুল্লাহ মাসুদ। কিন্তু এতেও কোনো কাজ হয়নি। তারপর থেকে এ পর্যন্ত সাহেদ আর কোনো টাকা পরিশোধ করেননি।
আজ বিচারক বাদী মাসুদের জবানবন্দি নিয়ে আদালত সাহেদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। আগামী ১৩ আগস্ট মামলার পরবর্তী দিন রেখেছেন আদালত।
চিকিৎসা সেবা নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে গত ৬ জুলাই বিকেল থেকে রাত অবধি রাজধানী উত্তরায় সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতালের মূল কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখান থেকে অভিযান শেষে হাসপাতালটির মিরপুর শাখায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় হাসপাতালটির আট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আটক করা হয়।
এরপর ৭ জুলাই রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের কোভিড ডেডিকেটেড রিজেন্ট হাসপাতালটি সিলগালা করে দেয় র্যাব-১। এ ছাড়া উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের রিজেন্ট গ্রুপের মূল কার্যালয়ও সিলগালা করা হয়। ৭ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করা হয়।
রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি সাড়ে প্রায় চার হাজার করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে। একজন কম্পিউটার অপারেটর বসে বসে সাড়ে চার হাজার রিপোর্ট তৈরি করেছেন। মনগড়া রিপোর্ট পজিটিভ-নেগেটিভ দিয়েছেন।
তা ছাড়া মোট ১০ হাজার রোগীর করোনা টেস্টের নমুনা সংগ্রহ করে রিজেন্ট হাসপাতাল। মাত্র চার হাজার ২৬৪টি নমুনা সরকারিভাবে টেস্ট করে রিপোর্ট দেয়। এ ক্ষেত্রে ভয়াবহ প্রতারণার কৌশল গ্রহণ করে রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কারো জ্বর থাকলে তাকে পজিটিভ আর জ্বর না থাকলে নেগেটিভ রিপোর্ট প্রদান করে।
এদিকে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ করিমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তাঁর পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। সাহেদকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ শুধু করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে জালিয়াতিই করতেন না। তিনি রিকশা ও ভ্যানের ভুয়া লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবসাও করতেন।
গতকাল রোববার রাতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ এনটিভি অনলাইনকে এই তথ্য জানিয়েছেন।
আশিক বিল্লাহ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘রিজেন্টের মালিক সাহেদ ভুয়া রিকশা ও ভ্যানের লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবসা করতেন। গতকাল শনিবার আমরা রিজেন্ট গ্রুপের উত্তরার প্রধান শাখায় অভিযান চালিয়ে রিকশা-ভ্যানের ভুয়া লাইসেন্স উদ্ধার করি। তবে গতকাল সব কাগজপত্র দেখা হয়নি। আজ সব চেক করতে গিয়ে দেখি সেখানে ৫০০টি রিকশা ও ২০০টি ভ্যানের ভুয়া লাইসেন্স।’
আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘যাদের সে (সাহেদ) ভুয়া লাইসেন্স দিত তাদের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা করে নিত। আর প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে সাহেদকে দিতে হতো। জব্দকৃত ওই লাইসেন্সগুলোতে ইস্যু দানকারী হিসেবে সাহেদের নাম-নম্বর ছিল। ভুয়া লাইসেন্স দেওয়া সেই যানবাহনগুলো তুরাগ, রানাভোলা এলাকায় চলাচল করত।’
সাহেদ নানাবিধ প্রতারণার ফাঁদ পেতে অর্থ আয় করে আয়েশি জীবন-যাপন করতেন। সব সময় নিজের সঙ্গে দুজন গানম্যান রাখতেন। রাস্তায় ভিআইপি মর্যাদা নিতে গাড়িতে বাজাতেন সাইরেন। তবে শুধু সাহেদ নয়, আয়েশি জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তাঁর স্ত্রী সাদিয়াও। তাঁর গাড়িতেও ছিল সাইরেন। সঙ্গে সব সময় একজন গানম্যান থাকত বলে সাদিয়া নিজেই এনটিভি অনলাইনকে এই তথ্য জানিয়েছেন। তবে সাদিয়াকে সাহেদ যেভাবে চলতে বলতেন তিনি সেভাবেই চলতেন বলে জানিয়েছেন।