সুস্থ হলেও ঠিকানাহীন মানসিক হাসপাতালের ১০ রোগী
চিকিৎসা শেষে পুরোপুরি সুস্থ হলেও বাড়ি ফিরতে পারছে না পাবনা মানসিক হাসপাতালের ১০ রোগী। বছরের পর বছর ধরে হাসপাতালে পড়ে আছেন তাঁরা। এদের কেউ ৩৫ বছর, কেউবা ২৫ বছর আবার কেউ আছেন এক যুগ ধরে। ভুল ঠিকানা দিয়ে ভর্তি করার পর এসব রোগীদের আর খোঁজ রাখেনি পরিবার। কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় তাঁরা হাসপাতালেই রয়ে গেছেন। অপরদিকে নানা সংকট আর প্রতিকূলতার মধ্যেই চলছে দেশের বিশেষায়িত একমাত্র এই মানসিক হাসপাতালটি। এমন অবস্থায় আজ ১০ অক্টোবর বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’।
পাবনার মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, এসব রোগী যখন ভর্তি হয়েছিল তখন জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল না। ফলে রোগীর স্বজনদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রোগী ভর্তি করা হতো। কিছু রোগীর স্বজন প্রতারণা করে ভুল ঠিকানা দিয়েছে হাসপাতালকে। যদিও বর্তমানে রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে রোগী ও রোগীর স্বজনদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি রাখেন।
এদিকে সুস্থ হয়ে ওঠা ওই ১০ জনের স্বজনরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় হতাশায় ভুগছেন তাঁরা। আবারও মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়েছেন। কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। এদের অনেকেই বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। শেষ জীবনে পরিবারের সদস্যদের ছাড়াই একাকিত্ব জীবন তাদের কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেও এদের বেশিরভাগই বাড়ি ফিরতে উন্মুখ হয়ে আছেন। অনেকটা বন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে এসব নারী-পুরুষদের।
এই ১০ জনের মধ্যে একজন নাজমা নিলুফার। মানসিক সমস্যার জন্য স্বজনরা ১৯৮৯ সালে এই হাসপাতালে ভর্তি করেন তাকে। ভর্তির সময় নিলুফারের বয়স ছিল ২৮ বছর। নিলুফারের বর্তমান বয়স ৫৮ বছর। প্রথম দিকে পরিবারের লোকজন খোঁজ-খবর রাখলেও একটা সময় গিয়ে তারা আর কোনো খবর রাখেনি। দীর্ঘদিন চিকিৎসায় এক সময় নিলুফার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন। ভর্তির সময় দেওয়া তাঁর বাড়ির ঠিকানা অনুযায়ী যোগাযোগ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে সেই ঠিকানায় নিলুফারের পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। জানা যায়, পরিবার থেকে ভর্তির সময় ভুল ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশে নিলুফার অনেক আগেই ছাড়পত্রের জন্য উপযুক্ত হয়েছেন। স্বজনরা কেউ না আসায় তিনি এখন হাসপাতালেই জীবনের শেষ সময়গুলো পার করছেন। হাসপাতালের রেজিস্ট্রেশন বই অনুযায়ী ভর্তির সময় নিলুফারের বাবার নাম দেওয়া হয়েছিল একে লুৎফুল করিম। তাঁর ভাইয়ের নাম পারভেজ করিম। ঢাকার মিরপুর ১১ নম্বর উল্লেখ ছিল। নিলুফার বর্তমানে হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে আছেন।
এমন আরেকজন সাঈদ হোসেন খান। ১৯৯৬ সালের ২২ জুলাই পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ভর্তির সময় তাঁর বাবার নাম লেখা ছিল আবুল হাসেম মিয়া। মায়ের নাম দেওয়া ছিল হেলেনা বেগম। ঠিকানা পাবনার রাঘবপুর এলাকা। ভর্তির সময় সাঈদের বয়স ছিল ৩৬ বছর। বর্তমানে তাঁর বয়স ৫৯ বছর। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে মেডিকেল বোর্ড তাকে ছাড়পত্রের জন্য উপযুক্ত বলে সুপারিশ করেছে। কিন্তু পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই ঠিকানায় তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। পরিবারের পক্ষ থেকেও কেউ যোগাযোগ করেনি। ফলে তিনিও লম্বা সময় ধরেই হাসপাতালের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা হয়ে রয়েছেন।
মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯৯৯ সালের ৪ মে মানসিক রোগী হিসেবে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন শাহানারা আক্তার। হাসপাতালের খাতায় তাঁর বাবার নাম উল্লেখ ছিল মৃত সিদ্দিকুর রহমান, মায়ের নাম জরিনা বেগম। ভাই মানিক মিয়া (দর্জি)। ঢাকার মানিকনগর এলাকা তাঁর ঠিকানা লেখা ছিল। শাহানারার পরিবার প্রথম দিকে খোঁজ নিতে আসত। সময়ের ব্যবধানে খোঁজ নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। নিয়মিত চিকিৎসা চলে শাহানারার। এক সময় ভালো হয়ে গেলেও পরিবারের কাছে আর ফিরে যেতে পারেননি তিনি। এখন তাঁর বয়স ৪৬ বছর। হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ড তাঁর জন্য বরাদ্দ।
একই পরিণতি অনামিকা বুবি, শিপ্রা রাণী রায়, গোলজার বিবি, বদিউল আলম, নাইমা চৌধুরী, জাকিয়া সুলতানা এবং ডলির। এদের মধ্যে শিপ্রা রাণী রায় ছাড়া বাকি সবাই পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন। মেডিকেল বোর্ড তাদেরকে সুস্থ বলে ছাড়পত্রের জন্য সুপারিশ করেছেন। শিপ্রা রাণী রায় এখনও সুস্থ হয়ে ওঠেননি। তাঁর চিকিৎসা চলমান।
এরা কোথায় যাবে ঠিকানা জানে না। চিকিৎসায় সেরে ওঠার পর তাঁরা যখন বুঝতে পারছে তাদের পরিবার তাদের নিতে চাচ্ছে না, খোঁজ নিচ্ছে না, তখন তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েছে। কোথায় যাবে ভেবে না পেয়ে এখানেই থেকে গেছেন। মানসিক রোগীদের সঙ্গেই জীবন কাটাচ্ছে সুস্থ হয়ে ওঠা এসব মানুষ। কষ্ট বুকে চেপেই তাঁরা চুপচাপ অন্যের স্বজনদের আসা-যাওয়ার দৃশ্য দেখে। ঈদ যায়, পূজা যায়, তারা অপেক্ষায় থাকে পরিবারের সদস্যদের। চায় এই পরিবেশ থেকে মুক্তি।
এদিকে ১৭ কোটি মানুষের দেশে শতকরা ১৫ শতাংশ অর্থাৎ আড়াই কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগী। আর এই ১৭ কোটি মানুষের এক দশমিক দুই ভাগ মানুষ অর্থাৎ ১৯ লাখ ৩০ হাজার মানুষ ঘোরতর মানসিক রোগী। এদের মধ্যে বেশির ভাগই তরুণ-তরুণী। আর এই রোগীদের চিকিৎসার জন্য দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মাত্র ১২০ জন এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল মাত্র একটি। অপ্রতুল চিকিৎসা সেবার কারণে দিন দিন বাড়ছে মানসিক রোগীর সংখ্যা।
একমাত্র বিশেষায়িত এই হাসপাতালটি ১৯৫৭ সালে পাবনা শহরের শীতলাই হাউজের জমিদার বাড়িতে ৬০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করে। শীতলাই হাউজে ১৯৫৭ থেকে শুরু করে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সেবা দেওয়ার পর তা পাবনা শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে পদ্মার তীরে হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হয়। ১১১ দশমিক ২৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত নতুন ভবনে হাসপাতালটি পরে ২০০ থেকে পর্যায়ক্রমে ৪০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। পরে ২০০৩ সালে মেন্টাল হেলথ রির্সাস ইনস্টিটিউটের আওতায় আরও ১০০ বেডে বাড়িয়ে ৫০০ শয্যায় উন্নীত হয়। বর্তমানে এ হাসপাতালে ১৫০টি পেয়িং শয্যা ও ৩৫০টি নন পেয়িং শয্যা মিলে মোট ৫০০টি শয্যা রয়েছে। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে অন্যতম এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন পাবনার তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ হোসেন গাংগুলী।
এখানে মাদকাসক্ত নিরাময় ওয়ার্ডসহ মোট ১৮টি ওয়ার্ড রয়েছে। এই হাসপাতালে বহির্বিভাগ, আন্তবিভাগ, বৃত্তিমূলক ও বিনোদনমূলক চিকিৎসা বিভাগ রয়েছে। এক্সরে, প্যাথলজি, ইসিজি, ইইজিসহ এই মানসিক হাসপাতালকে ঘিরে চলে চিকিৎসক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, প্যারামেডিক্স, সেবক, সেবিকাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। দীর্ঘ ৬১ বছর পার হলেও আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া লাগেনি হাসপাতালটিতে। হাসপাতালের জন্য নতুন কোনো ভবন, চিকিৎসার আধুনিক সরঞ্জামাদি, মনরোগ চিকিৎসার জন্য গবেষণাগার, মেডিসিন সংরক্ষণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির স্টোররুম, চিকিৎসক ও কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন কোনটিই নির্মিত হয়নি।
২০০ শয্যার জনবল দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালটি। ২০০ শয্যার হাসপাতাল হিসেবেই এখানে মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা ৪৭২টি। এর মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ৩৩৬ জন। বাকি ১৩৬টি পদ শূন্য পড়ে আছে। বর্তমানে মাত্র পাঁচজন মেডিকেল কর্মকর্তা দিয়ে চলছে চিকিৎসা সেবা। তারাও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ নয়। পাবনা মেডিকেল কলেজের কয়েকজন সহকারী অধ্যাপক অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়াও দুইটি সিনিয়র কনসালটেন্ট, একটি ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট, একটি আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা, সাতটি ক্লিনিক্যাল এসিস্টেন্ট, পাঁচটি মেডিকেল অফিসার, দুইটি সহকারী রেজিস্ট্রারের পদ শূন্য পড়ে আছে। অপরদিকে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ১২৫টি পদও শূন্য। এতে করে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানায়, সাধারণ রোগীর চেয়ে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা পদ্ধতি একটু ভিন্ন। তাই রোগীদের সুস্থ করে তোলার জন্য মেডিসিনের পাশাপাশি বৃত্তিমূলক চিকিৎসার বিশেষ প্রয়োজন। এসব বৃত্তিমূলক চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে, শরীরচর্চা, ইনডোর-আউটডোর খেলাধুলা, সঙ্গীত, বিনোদনমূলক সিনেমা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সুস্থ হয়ে ওঠার পর দরিদ্র রোগীদের পুনর্বাসনের জন্য তাঁত, বেত ও দর্জি কাজের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এক সময় থাকলেও এসব এখন রয়েছে বন্ধ। এসব কাজের জন্য ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় রোগীদের বিনোদন ও পূনর্বাসনমূলক কোনো কাজই করা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না।
এ ব্যাপারে পাবনা মানসিক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রতন কুমার বলেন, ‘অশান্তি, হতাশা, বিষাদ, ভয়, আঘাত এবং বংশগত কারণে মানুষ অবহেলা অযত্নে মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে।’
অপরদিকে হাসপাতালের আশপাশসহ শহরের বিভিন্নস্থানে মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্র নামে ক্লিনিকের দালালদের খপ্পরে পড়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন অনেকেই। এর বাইরে আউটডোরে সেবা নিতে এসেও হয়রানিতে পড়ে কেউ কেউ।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. রতন কুমার বলেন, ‘আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে ১১০ থেকে ১৩০ জন রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়। অনেকে দূর থেকে রোগী নিয়ে আসে খুব সকালে, তাদের বসে থাকতে হয় অফিস খোলা পর্যন্ত। এ সময় অনেক দালাল তাদের ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে কেউ যেন প্ররোচিত হয়ে অন্য কোথাও না যায়, হয়রানির শিকার না হয়, সেজন্য আউটডোরে সশস্ত্র আনসার নিয়োগ রয়েছে। তাঁরা সতর্ক আছে, পাশাপাশি আমাদের কর্মচারীরাও সতর্ক থাকে।’