‘অপরিহার্য’ আশরাফ একদিনের ব্যবধানেই ‘অচেনা’
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/07/11/photo-1436553015.jpg)
একদিনের ব্যবধানেই পাল্টে গেছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বাসভবনের চিত্র! সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে একটুখানি সাক্ষাতের আশায় সাত-সকাল থেকেই ভিড় লেগে থাকত মন্ত্রিপাড়া-খ্যাত রাজধানীর মিন্টু রোডের তাঁর বাসায়। কিন্তু শুক্রবার সেখানে গিয়ে দেখা যায় একেবারে ভিন্ন চিত্র। বাসার বাইরে বা ভেতরে দলীয় নেতাকর্মীদের কোনো ভিড় নেই। নেই কোনো হাঁক-ডাকও। এমনকি তাঁর নিজের নির্বাচনী এলাকার দলীয় নেতাকর্মী বা কোনো লোকজনকেও আজ দেখা যায়নি।
আশরাফ-ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবার হাতেগোনা কয়েকজনই সৈয়দ আশরাফের বাসায় এসেছেন। এদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন, আওয়ামীপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা জাকারিয়া স্বপন, সৈয়দ আশরাফের পাশের জেলা নেত্রকোনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের একজন শীর্ষ নেতা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জানান, যাঁরা আজ তাঁর বাসায় এসেছেন বেশির ভাগই বন্ধু-বান্ধব। তাঁদের সঙ্গে সারা দিন আড্ডা দিয়েছেন আশরাফ, ছিলেন ফুরফুরে মেজাজে।
তবে আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, আশরাফকে দপ্তরবিহীন করার ঘটনায় দলের অনেক নেতাই রীতিমতো অবাক হয়েছেন। তাঁরা এখনো বিষয়টি বুঝে উঠতে পারছেন না। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতেই তাঁরা আশরাফের বাসা এড়িয়ে চলছেন।
বৃহস্পতিবার বিকেলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের (এলজিআরডি) মন্ত্রীর পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ওই পদে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে দায়িত্ব দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি আগের মন্ত্রণালয়ে (প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়) অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবেন এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দপ্তরবিহীন মন্ত্রী থাকবেন বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের টালমাটাল রাজনীতিতে দেনদরবার করে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কারামুক্ত করে ও নির্বাচন আদায় করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং সরকারের ভেতরে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বিনিময়ে পান দলের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
সর্বশেষ ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় দলের ভেতরে তাঁর অবস্থান আরো সুদৃঢ় করে। এভাবে দল ও সরকারের জন্য এতদিন অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য মনে করা হতো সদ্য সাবেক হওয়া স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে।
কিন্তু মন্ত্রিত্ব হারানোর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সেই গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ব্যক্তিটি ‘কৃতকর্মের’ ফল পেয়েছেন এমন মন্তব্য নিজস্ব বলয় ও বিপক্ষ বলয়ের নেতাদের। দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা তাঁর ‘খুঁত’ বের করার চেষ্টা করছেন। শুধু বিপক্ষ বলয়ের নেতারাই নয়, পক্ষের নেতারাও মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতির ঘটনায় ‘দুষছেন’ আশরাফকে।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আশরাফ মেধাবী, যোগ্য-এ ধরনের সব বিশেষণ তাঁর সঙ্গে যায়। কিন্তু দল ও সরকারের কাজে তাঁর যে অনীহা তা কতদিন সহ্য করা যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক দিন সহ্য করেছেন। আমি মনে করি, সর্বশেষ দপ্তর হারানোর দায় তাঁরই।’
কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আশরাফ দুবার দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু সবগুলো সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে তিনি চেনেন না। সরাসরি তো তাদের সঙ্গে কথা হয়নি, মনে হয় ফোনেও একবার কথা হয়নি তাঁর সঙ্গে। এ রকমভাবে কর্ম সম্পাদন হয় না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশরাফকে অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছেন উল্লেখ করে দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর আরেক নেতা বলেন, ‘তাঁকে শোধরানোরও সময় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হয়নি। ফলে পরিণাম যা হওয়ার তাই হয়েছে।’
(আওয়ামী লীগের এই তিন নেতাই আশরাফ-ঘনিষ্ঠ হিসেবে দলে পরিচিত।)
এদিকে আশরাফকে দপ্তরবিহীন করার ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আশরাফের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অনুপস্থিতির একটি অভিযোগ আছে। যেহেতু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ, তাই মন্ত্রণালয়কে গতিশীল করতে প্রধানমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে হয়।’
সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ এনটিভি অনলাইনকে জানান, ‘এটা খুব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তা আমি বলব না। শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার প্রধান, তিনিই ঠিক করবেন কাকে রাখবেন আর কাকে রাখবেন না। নিশ্চয়ই প্রয়োজন ছিল তাই আশরাফের স্থলে অন্যকে স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে।’
‘বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ায় দেখেছি, আশরাফ নিয়মিত মন্ত্রণালয়ে যান না, সে কারণেও হতে পারে।’ যোগ করেন কাজী জাফর উল্যাহ।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, দলে আরো সক্রিয় হতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন দলকে আরো বেশি সময় দিতে পারবেন তিনি। আশরাফ তাঁর অবস্থানেই থাকবেন।
সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে দু-দুবার সাধারণ সম্পাদকের দৌড়ে পিছিয়ে পড়া সভাপতিমণ্ডলীর অপর সদস্য ওবায়দুল কাদেরও বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর বাবুবাজার ব্রিজ পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক সরকারের মন্ত্রিসভায় কে থাকবেন আর কে থাকবেন না এটি পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর বিষয়। তিনি যদি মনে করেন কাউকে মন্ত্রিসভায় রাখলে দলের মঙ্গল হবে, তাহলে তাঁকে রাখবেন। আর কাউকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দিলে তিনি দলীয় কাজে সময় দিতে পারবেন বলে মনে করেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রী তাই করবেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, আমার মনে হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী মনে করছেন সৈয়দ আশরাফ বেশি ভার বহন করছেন। তাই দলীয় কাজে বেশি সময় দেওয়ার জন্য তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে।’
প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, হয়তো দেশ, জাতি, দল ও গণতন্ত্রের কল্যাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
শুক্রবার দুপুরে রাজধানীতে একটি আলোচনা সভায় সুরঞ্জিত আরো বলেন, ‘সৈয়দ আশরাফ একজন আপাদমস্তক রাজনীতিক। তাঁর কাছে মন্ত্রিত্বের পোর্টফোলিও বড় ব্যাপার নয়। তিনি যেখানেই থাকেন, পারিবারিক ঐতিহ্য ও জাতীয় চার নেতার একজনের সন্তান হিসেবে নিজস্ব মেধা ও মননে একজন সৎ রাজনীতিবিদ হিসেবে ভূমিকা রাখবেন।’