‘আমার জীবন তো যায় যায়’

বারো বছর আগের কথা। ক্ষ্যাপা একটি কুকুর তাড়া করেছিল খায়রুন্নেছাকে। পালাতে গিয়ে সড়কের পাশের একটি ড্রেনে পড়ে যান। ভেঙে যায় একটি পা। এতেই তিনি অচল হয়ে পড়েন। এর পর বিভিন্নজনের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই পা আর ভালো হয়নি। খায়রুন্নেছার পঙ্গুত্বও কাটেনি। সেই থেকে জীবনধারণের জন্য ভিক্ষাই তাঁর একমাত্র সম্বল। হাতল-ভাঙা একটি রিকশায় বসে নাতনি প্রিয়া খাতুনকে নিয়ে সাতক্ষীরা শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ান। যে টাকা পান, তা দিয়ে খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটে।
খোঁজখবর নিতে এ প্রতিবেদক কথা বলেন ৭০ বছরের এ বৃদ্ধার সঙ্গে। জানতে চান তাঁর রোজনামচা। জবাবে খায়রুন্নেছা বলেন, ‘দিনভর বৃষ্টির জন্য বাড়ি থেকে দুই-তিন দিন বের হতে পারেননি। খুব কষ্টেই চলেছে এ ক’টা দিন।’
‘দুপুরে কোনো দিন বাড়ি আসা পড়ে, আবার কোনো দিন না এইসি একবারে বিকেলে ফিরে নাতনিডা ভাত চড়ায়। রাতে খাই, সকাল খাই পান্তা। আর দুপুরি বাইরে থেকে এটা-ওটা কিনি খেতি হয়,’ বলেন খায়রুন্নেছা।
নিজের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে ৭০ বছর বয়সী পঙ্গু ওই নারী বলেন, ‘আমার জীবন তো যায় যায়। পুতনিডার (নাতনি) কী উপায় হবে? তার বিয়ে দেব কোথায়? আর সে টাকাই বা কই?’
খায়রুন্নেছা বলেন, স্বামী করিম গাজী মারা গেছেন অনেক আগেই। তিন ছেলে কবির গাজী, আমিনুর রহমান ও কামরুল ইসলাম যে যার মতো ভ্যান, রিকশা চালিয়ে সংসার নিয়ে থাকে। কেউ দেখে না তাকে।
সন্তান প্রসবের সময় খায়রুন্নেছার বড় ছেলে কবিরের স্ত্রী মারা যান। সেই সন্তান প্রিয়া এখন বড় হয়েছে। আর তাকে নিয়েই চলে সংসার।
সকাল থেকে সাতক্ষীরা শহরের রিকশাটি ঠেলে নিয়ে চলে প্রিয়া। দিনভর ভিক্ষা করার পর শহরের সরকারি কলেজপাড়ার রাজারবাগানে ভাঙাচোরা বাসায় যায় দাদি-নাতনি। কোনোরকমে রাত পার হয়। কিন্তু মাস শেষে ৩০০ টাকা বাসা ভাড়া আর আনুষঙ্গিক খরচ দিতেই হিমশিম খেতে হয়।
সুন্দরবনসংলগ্ন শ্যামনগরের খোলপেটুয়া নদীর তীরে নোয়াবেকি গ্রামে খায়রুনদের বাড়ি। গ্রামের বাড়িতে জমি বলতে কিছুই নেই। ঘরবাড়িও নেই। বেঁচে থাকার তাগিদে নাতনি প্রিয়াকে নিয়ে চলে আসেন সাতক্ষীরায়। এর পর অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন।
‘অন্যের বাড়িতে কাজকর্ম করে একরকম চলছিল। কিন্তু সে সুখ আর বেশিদিন সইল না বাবা,’ ব্যথাভরা কণ্ঠে বলেন খায়রুন্নেছা।
ঈদে ফিতরার টাকা জোগাড় করে রিকশাটি কিনেছিলেন। এটাতে বসেই ১২ বছর ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কিন্তু আর কত দিন এভাবে চলবে, তা জানেন না খায়রুন্নেছা। নাতনির ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত তিনি।
দিনভর বিভিন্নজনের কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে সর্বোচ্চ শ’খানেক টাকা পান খায়রুন্নেছা, তা-ও আবার সব দিন হয় না। বর্ষা তো আছেই। তবে ভিক্ষা করতে বের হলে কেউ তাঁকে ফিরিয়ে দেয় না। কিছু না কিছু হাতে দেয়।
তিন ছেলে থাকার পরও কষ্টে থাকতে হয় জানিয়ে খায়রুন্নেছা বলেন, ‘আজ যদি একটি মেয়ে থাকত, হয়তো তার ঘরে তুলে নিয়ে আমাকে সেবাযত্ন দিত। সবই নসিবের দোষ।’
‘আল্লাহ ছেলেদের হেদায়েত করুক। আর আমার পুতনিডার একটি গতি হোক। এতেই আমার শান্তি,’ আক্ষেপ করে বলেন খায়রুন্নেছা।