হালদার দুঃখ রাবার ড্যাম!

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ভুজপুর এলাকায় হালদা নদীর ওপর ১৩ বছর আগে তৈরি করা হয় একটি রাবার ড্যাম (বাঁধ)। দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে স্থাপন করার জন্য নির্মিত রাবার ড্যামটি বর্তমানে হালদার দুঃখে পরিণত হয়েছে।
রাবার ড্যামের কারণে এখন বছরে চার মাস হালদার উজানের অন্তত ১০ কিলোমিটার প্রায় পানিশূন্য থাকে। ডিম আহরণ, রেণু ও মাছ উৎপাদনে ধসের পাশাপাশি রাবার ড্যামের কারণে বিলীন হতে বসেছে হালদা নদীর অস্তিত্ব। নদীর বড় একটি অংশে নেই পানির চিহ্ন। পরিণত হয়েছে ধু ধু মরুভূমিতে। পরিবেশের পাশাপাশি হুমকির মুখে হালদার জীববৈচিত্র্য।
কৃষকেরা জানান, রাবার ড্যামের ফলে চালু হওয়ার এক যুগেও নিরবচ্ছিন্ন পানিপ্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়নি। এ কারণে রাবার ড্যামটি কৃষকের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। অথচ, পূর্ব ভূজপুরের আমতলি বিল, আড়ালিয়া বিল, হরিণাকুল, পূর্ব খৈয়া পুকিয়া বিলে বোরো খেতে সহজলভ্য সেচ সুবিধা নিশ্চিত করে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্যই হালদা নদীতে ড্যামটি স্থাপন করা হয়।
স্থানীয় কৃষকেরা আরও জানান, রাবার ড্যাম যখন ছিল না তখন দুই হাজার টাকা দিয়ে জমি চাষ করতাম ৪০ শতক। প্রথম বছর ফ্রিতে, এর পরের বছর ৬০০ টাকা থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে এক হাজার ৫০০ টাকা শতক। তাহলে রাবার ড্যাম থেকে লাভ কী? উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), ফটিকছড়ি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে উপজেলার ভুজপুর ইউনিয়নের আমতলি এলাকায় রাবার ড্যাম স্থাপন করে এলজিইডি। ওই বছরের মার্চে ড্যামটি চালু করা হয়। প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ধরা হয় প্রায় আট কোটি টাকা। হালদা নদীতে নির্মিত ড্যামটি দৈর্ঘ্যে ১০০ মিটার ও প্রস্থে ৪ দশমিক ৫ মিটার।
উপজেলার ভুজপুর ও নারায়ণহাট ইউনিয়নের ৫০০ হেক্টর বোরো ধানের জমি সহজ আবাদের লক্ষ্যেই ভুজপুর রাবার ড্যামটি স্থাপন করা হয়েছিল। পাশাপাশি উজানের অংশের শাখা খাল ও ছড়া সংস্কার করে পানি জমিয়ে রেখে কম খরচে বোরো আবাদ ও পার্শ্ববর্তী চারটি চা বাগানের সেচ সুবিধা দেওয়া ছিল অন্যতম লক্ষ্য।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ড্যামটির নিচের অংশে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে হালদা শুকিয়ে চৌচির হয়েছে। উপজেলা পাইন্দংয়ের ফকিরাচান বিল, ভুজপর আমতলী বিলের কিছু অংশ ও হারুয়ালছড়ির ফটিকছড়ি বিলে পানি না পেয়ে বোরো আবাদ হয়নি প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে। এতে কৃষকের লাভের চেয়ে ক্ষতি হচ্ছে বেশি। রাবার ড্যামের ফলে মাছের ডিম সংগ্রহ ও পোনা উৎপাদনও কমে যাচ্ছে দিনদিন।
মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, ২০২৪ সালে হালদা নদী থেকে মাছের ডিম আরোহণ হয়েছে ১ হাজার ৮৪০ কেজি। এক বছর আগে এর পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৬৬৪ কেজি। গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম ডিম আহরণ হয়েছে ২০২৪ সালে। একইভাবে ২০২০ সালে রেণু উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩৯২ কেজি। ২০২১ ও ২০২২ সালে এর পরিমাণ কিছুটা কমলেও ২০২৩ সালে উৎপাদন হয় ৪৩৬ কেজি। ২০২৪ সালে আহরণ হয় মাত্র ৪৬ কেজি।
উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, হালদা নদী থেকে স্মরণকালের সবচেয়ে কম ডিম আহরণ ও রেণু উৎপাদন হয়েছে ২০২৪ সালে। এমন পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান চৌধুরী শিপন বলেন, ‘কৃষকের পানি সেচ সুবিধা দিতে অনেকগুলো মেশিন বসানো হয়েছে। এসবের বাড়তি খরচ মেটাতে এ বছর কিছু টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে, যা আগামী বছর থেকে কমে যাবে।’
নাজিরহাট পৌরসভার বাসিন্দা সাংবাদিক দৌলত শওকত বলেন, ‘রাবার ড্যামে বাঁধ দেওয়ার ফলে হালদার একটি অংশ মৃত। যদি ওইভাবে পানি বন্ধ থাকে তাহলে আর বেশিদিন সময় লাগবে না হালদা শুকিয়ে মরে যেতে।’
মৎস্য কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘হালদার ভুজপুর বাঁধটা হলো ক্যানসারের মতো, ক্যানসারের কোষটি যদি না উঠে হালদা বিলীন হয়ে যাবে। রাবার ড্যামের কারণে একটি অংশে পানি কমে যাওয়ার ফলে ব্যাপক খাদ্যাভাব দেখা দিচ্ছে। এর ফলে পাইন্দং, সুন্দরপুর, হারুয়ালছড়ি, নাজিরহাট পৌরসভা এই অংশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন শূন্যের কোটায়।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা গবেষক ড. মুহাম্মদ মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদা নদীতে মাছ উৎপাদন ও ডিম সংগ্রহ কমার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী রাবার ড্যাম। বাঁধ কার্যকর থাকা অবস্থায় ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ভুজপুর, নারায়ণহাট, হারুয়ালছড়ি ও নাজিরহাট এলাকায় হালদা নদীর প্রতি ঘনমিটার পানিতে প্ল্যাঙ্কটন ও বেনথোসের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসে। অন্যদিকে এসব এলাকায় মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রতি ঘনমিটার পানিতে ২০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখের মধ্যে প্ল্যাঙ্কটন ওঠা-নামা করে। উজানের বাঁধের প্রভাব পড়ে ভাটির পানিতেও। বাঁধ কার্যকর মৌসুমে (ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত) মাছের প্রজনন এলাকা রাউজান উপজেলার সত্তারঘাট থেকে হাটহাজারীর মদুনাঘাট পর্যন্ত নদীর প্রতি ঘনমিটার পানিতে প্ল্যাঙ্কটন পাওয়া গেছে ৫০ হাজার বা তার কিছু বেশি। অথচ একই এলাকায় মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি ঘনমিটার পানিতে দেড় লাখ পর্যন্ত প্ল্যাঙ্কটন পাওয়া গেছে। এই সময়ে প্রতি বর্গমিটার পানিতে বেনথোস পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ২০০। যেটি মার্চ মাসে ডাউন করার কথা থাকলেও ডাউন হয় মে মাসে, যার ফলে পানি দূষিত হয়ে মাছের প্রজনন স্বাভাবিক হয় না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রাবার ড্যামের নিচের অংশটুকু পানি শূন্যতার ফলে চর হয়ে যায়, যার ফলে বালি ও মাটি চুরি হয়ে যায়। তাছাড়া বাঁধের কারণে নদীর নিচের অংশে মাছের খাদ্য ক্ষুদ্র প্রাণী ও জলজ উদ্ভিদের ঘাটতি দেখা দেয়। এ কারণে মৃগেল ও কালিবাউশ মাছ কমে যাচ্ছে। এখন সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রাবার ড্যাম থাকবে কি না।