বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ সেলিমের পরিবারে বিষাদের ঈদ!

ঈদ এলেই বাবা-মা ও স্ত্রীসহ আত্মীয়-স্বজনদের জন্য নতুন পোশাক কিনে আনতেন সেলিম তালুকদার। সন্তানের উপহার পেয়ে ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা থাকতেন বাবা-মা। স্বামীকে নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতেন স্ত্রী। স্বামীর দেওয়া ঈদের উপহারে যেন উৎসবের আমেজ বিরাজ করত। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সেই সেলিম তালুকদারের পরিবারে এবার বিষাদের ঈদ। পুলিশের বুলেট থামিয়ে দিয়েছে সব আনন্দ। ম্লান হয়ে গেছে বাবা-মা ও স্ত্রীর সব স্বপ্ন।
ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ঝালকাঠির নলছিটির সন্তান সেলিম তালুকদার। মৃত্যুর সাত মাস পরে গত ৮ মার্চ তাঁর স্ত্রী সুমী আক্তারের কোলজুড়ে আসে কন্যা সন্তান। বাবার নামের সঙ্গে মিলিয়ে নবজাতকের নাম রাখা হয় সাইমা সেলিম রোজা।
নলছিটি শহরের মল্লিকপুর এলাকায় শহীদ সেলিমের বাসায় গিয়ে তাঁরা কেমন আছেন জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা সুলতান তালুকদার ও মা সেলিনা বেগম।
ঈদের প্রসঙ্গে বাবা সুলতান তালুকদার বলেন, ‘আমাদের পরিবারে আর কখনো ঈদের আনন্দ হবে না। আমার একমাত্র ছেলে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর থেকেই আমাদের সুখ ম্লান হয়ে গেছে। ঈদ এলে ছেলের দেওয়া পাঞ্জাবি পড়ে নামাজে যেতাম। মনের মাঝে একটা আনন্দ থাকত। এবার সেই আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়েছে।’
বিলাপ করে সেলিমের মা সেলিনা বেগম বলেন, ‘আমাদের এখন আর পরিবার নেই। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছে মন। ঈদের আমাদের কোনো আনন্দ নেই। সেলিমের স্ত্রী নবজাতক সন্তানকে নিয়ে ঝালকাঠি শহরে তাঁর বাবার বাড়িতে আছে। ঈদের দিন আমাদের বাড়িতে আসবে।’
মুঠোফোনে সেলিমের স্ত্রী সুমি আক্তার বলেন, ‘আমাদের ঈদ এখন রোজাকে ঘিরে। ওর বাবা বেঁচে থাকলে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারতাম। মেয়েটা তার বাবাকেই দেখল না, ঈদের আনন্দ কি থাকতে পারে! অনেকেই রোজার জন্য দোয়া করছেন, আবার কেউ উপহার পাঠিয়েছেন। যাঁরা আমাদের পরিবারের পাশে আছেন, সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’
জানা গেছে, ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মল্লিকপুর এলাকার বাসিন্দা সেলিম তালুকদার (২৮)। নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। আন্দোলনের সময় গত ১৮ জুলাই রাজধানীর মধ্যবাড্ডায় গুলিবিদ্ধ হন। ৩১ জুলাই রাতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ২ আগস্ট সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে। মৃত্যুর তিন দিন পরই (৪ আগস্ট) ছিল সেলিম-সুমি দম্পতির প্রথম বিবাহবার্ষিকী। ৮ আগস্ট স্বাস্থ্য পরীক্ষায় জানা যায়, সেলিমের স্ত্রী সুমী আক্তার অন্তঃসত্ত্বা। ৮ মার্চ দুপুর ১২টার দিকে সুমী আক্তারের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ঝালকাঠি শহরের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান দুনিয়ার আলো দেখতে পায়। কিন্তু প্রিয় সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি সেলিম তালুকদার।
সেলিম নলছিটি উপজেলার মল্লিকপুর এলাকার সুলতান হোসেন তালুকদারের ছেলে। তিনি বিজিএমই ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে আড়াই বছর আগে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। পরে নারায়ণগঞ্জে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সহকারী মার্চেন্ডাইজার পদে চাকরি শুরু করেন। তাঁরা তিন বোন ও এক ভাই। সেলিম ছিলেন মেজ।
নিহত সেলিমের স্ত্রী সুমী জানান, ওই দিন সকালে বাড্ডা লিংক রোডের কুমিল্লাপাড়ার বাসা থেকে বের হয়ে আন্দোলনে যোগ দেন সেলিম। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষের সময় সকাল ১১টার দিকে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।