ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধে কার্গো সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে বিমান

ভারত গত ৮ এপ্রিল হঠাৎ করেই বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে। এ সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার পর বাংলাদেশ দ্রুত বিমানের কার্গো অবকাঠামো বৃদ্ধি করছে। গুরুত্বপূর্ণ পণ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের নিরবচ্ছিন্ন রপ্তানি নিশ্চিত করতে সক্ষমতা বৃদ্ধি, জনবল নিয়োগ ও পরিবহণ খরচ কমানোর জন্য জরুরি এ পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এবং একমাত্র গ্রাউন্ড-হ্যান্ডলিং এজেন্ট বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স নিরবচ্ছিন্ন কার্গো কার্যক্রম সহজতর করতে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে।
গতকাল শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেছেন, আমরা (বেবিচক ও বিমান বাংলাদেশ) বিমানের কার্গোকে আরও সাশ্রয়ী করার জন্য বর্তমান বেসামরিক বিমান চলাচল ও গ্রাউন্ড-হ্যান্ডলিং শুল্ক সংশোধন করতে একসঙ্গে কাজ করছি।
বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, কার্গো কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত ফি ও খরচ সহজতর ও হ্রাস করতে সরকার বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সকল অংশীদারদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করছে।
মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, বাহ্যিক বাধা বিঘ্নের পরেও যেন বিমানে পণ্য পরিবহণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকে, সেজন্য আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা খুব শিগগিরই হ্রাসকৃত হ্যান্ডলিং চার্জ ঘোষণার আশা করছি।
বেবিচক ইতোমধ্যেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করেছে। এ ছাড়াও, সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২৭ এপ্রিল পূর্ণাঙ্গ কার্গো কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। এরপর শিগগিরই চট্টগ্রাম বিমানবন্দরেও তা শুরু হবে। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স দ্রুত করার জন্যও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
শুক্রবার বেবিচক চেয়ারম্যান কার্গো কার্যক্রম চালুর প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে সিলেট বিমানবন্দর পরিদর্শন করেন। ২৭ এপ্রিলের মধ্যে টার্মিনালের প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে তিনি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
সিলেটের অত্যাধুনিক কার্গো টার্মিনাল অত্যন্ত ক্ষমতা সম্পন্ন উল্লেখ করে মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালুর আগে আমাদের বিদ্যমান অবকাঠামো শিগগিরই দুই থেকে তিনগুণ বেশি কার্গো পরিচালনা করবে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মো. সাফিকুর রহমান জরুরি পদক্ষেপের কথা জানান। তিনি বলেন, ভারতের বন্দর হয়ে যেসব পণ্য পরিবহণ করা যাচ্ছে না, সেসব পণ্য পরিবহণের চাপ মোকাবেলায় নতুন কার্গো কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে।
বিমান বাংলাদেশের কার্গো পরিচালক শাকিল মিরাজ বলেন, আমাদের বিমান সংস্থা সিলেটে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং পরিষেবা প্রদানের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যেখানে গ্যালিস্টেয়ার এভিয়েশনের এয়ারবাস এ৩৩০-৩০০ পণ্যবাহী বিমান ২৭ এপ্রিল স্পেনে ৬০ টন তৈরি পোশাক পরিবহণ করবে।
শাকিল মিরাজ বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই ঢাকা থেকে সিলেটে গ্রাউন্ড-হ্যান্ডলিং সরঞ্জাম স্থানান্তর করেছি এবং উদ্বোধনী কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত রয়েছি। বিমান বাংলাদেশ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৭০০ জনেরও বেশি কর্মীর বর্তমান দলের পরিপূরক হিসেবে ৪০০ জন অতিরিক্ত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার নিয়োগ করছে।
গত সপ্তাহে বাণিজ্য এবং বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য সম্ভাব্য বিকল্পগুলো চিহ্নিত করতে এবং ক্ষতি কমাতে শিল্প সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন ব্যবসা-বান্ধব বাস্তুতন্ত্র তৈরিতে সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, বাণিজ্য সুবিধা ও বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বিমান কার্গো অবকাঠামো একটি মূল স্তম্ভ।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের বহুল প্রত্যাশিত তৃতীয় টার্মিনালটির কাজ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষ আশাবাদী, আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন এই টার্মিনাল আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনবে এবং বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করবে।
পুরোপুরি চালু হলে তৃতীয় টার্মিনাল বার্ষিক রপ্তানি পণ্য পরিবহণের ক্ষমতা দুই লাখ থেকে পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার টনে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যার মধ্যে ৩৬ হাজার বর্গমিটারের একটি নিবেদিত কার্গো জোন অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
বেবিচক চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, নতুন টার্মিনালে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ও বর্ধিত স্টোরেজ আমাদের আরও স্বাধীন ও দক্ষতার সঙ্গে পণ্য পরিবহণ করতে সাহায্য করবে। যার ফলে রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফা)-এর সভাপতি কবির আহমেদ তৃতীয় টার্মিনালের প্রশংসা করে এটিকে ‘দ্য ফাইনেস্ট অব ইটস কাইন্ড’ বলে অভিহিত করেছেন।
কবির আহমেদ বলেছেন, এটি সিঙ্গাপুরের বিমানবন্দর অবকাঠামোর সঙ্গে তুলনীয়। যার মধ্যে আধুনিক স্ক্যানিং, পরীক্ষা ও তাপমাত্রা-নিয়ন্ত্রিত স্টোরেজ সুবিধা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
খরচের চাপ ও ধারণ ক্ষমতায় ঘাটতি
ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে কলকাতা ও দিল্লির মতো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনের চার বছরের চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত রপ্তানিকারকদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় ওই রুটটি একটি গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক লাইফলাইন হয়ে ওঠে, যা অতিরিক্ত চাপে থাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তুলনায় দ্রুত ও কম খরচের বিকল্প সুবিধা দিয়েছিল।
বাফার মতে, প্রায় ৬০০ টন বা বাংলাদেশের সাপ্তাহিক পোশাক রপ্তানির ১৮ শতাংশ ভারতের রুট দিয়ে বিমানের মাধ্যমে পাঠানো হত।
বর্তমানে বাংলাদেশ প্রতি সপ্তাহে প্রায় তিন হাজার ৪০০ টন পোশাক বিমানের মাধ্যমে রপ্তানি করে। অন্যদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ মূলত প্রতিদিন ৩০০ টনের জন্য নির্মিত হয়েছিল। এটি পিক পিরিয়ডে এক হাজার ২০০ টনেরও বেশি পণ্য পরিবহণ করে।
রপ্তানিকারকরা দীর্ঘদিন ধরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লজিস্টিক বিলম্ব ও অপর্যাপ্ত অবকাঠামো নিয়ে অভিযোগ করে আসছেন। সীমিত স্থান ও অপর্যাপ্ত গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং ব্যবস্থার কারণে পণ্য প্রায়শই উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে।
বিমানে পণ্য পরিবহণ খরচ এখনো একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। বাফার তথ্য অনুসারে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতি কেজিতে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের জন্য শূণ্য দশমিক ২৯ মার্কিন ডলার (প্রায় ৩৫ টাকা) খরচ হয়, যা দিল্লি বিমানবন্দরে নেয় মাত্র শূণ্য দশমিক ০৫ মার্কিন ডলার (প্রায় ছয় টাকা)। ঢাকা বিমান বিমানবন্দরে প্রায় ছয় গুণ বেশি খরচ লাগে। ঢাকায় জেট জ্বালানিও ৩০ শতাংশ বেশি ব্যয়বহুল।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জেনারেল ম্যানেজার (জনসংযোগ) বুশরা ইসলাম বলেন, জেট জ্বালানিতে একটি বিমান সংস্থার পরিচালন ব্যয়ের ৪০ শতাংশ খরচ হয়। এ কারণেই ভারতীয় বিমানবন্দরগুলো রপ্তানিকারকদের জন্য বেশি পছন্দ হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী বিমানগুলো হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বার্ষিক এক লাখ ৭৫ হাজার টন কার্গো ভলিয়মের প্রায় ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ বহন করে। বিমান বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি বিদেশি ক্যারিয়ারকেও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং পরিষেবা প্রদান করে থাকে।
রপ্তানিকারকরা বলেছেন, বেবিচক একাধিক চার্জ আরোপ করে। যেমন-ওভারফ্লাইং, অবতরণ ও পার্কিং খরচ। ঢাকার রানওয়ে সীমাবদ্ধতার কারণে মালবাহী বৃহৎ বিমানগুলো যথাযথভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না।
আন্তর্জাতিক খুচরা কার্যক্রম সীমিত হওয়ার কারণে একমুখী কার্গো ফ্লাইট (শুধু এক দিকে পণ্য পরিবহনকারী ফ্লাইট) কম লাভজনক। বিপরীতে, ভারতের শহরগুলোতে প্রায়শই দ্বিমুখী বাণিজ্য হয়, যেখানে উভয় দিকেই পণ্য পাঠানো হয়। যা তাদের ফ্লাইটগুলোকে আরও কার্যকর করে তোলে।
বিমান বাংলাদেশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ভারতীয় বিমানবন্দরগুলোতে খরচ কম হওয়ার কারণ হলো তাদের বিমানের ফ্লাইট দ্বিমুখী (উভয় দিকেই পণ্য পরিবহণ করা হয়)।
এমিরেটস, ক্যাথে প্যাসিফিক, কাতার এয়ারওয়েজ, টার্কিশ এয়ারলাইন্স ও ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সসহ প্রধান বিমান সংস্থাগুলো শুধু ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কার্গো ফ্লাইট পরিচালনা করে।
বাফার উপ-কমিটির চেয়ারম্যান হিজকিল গুলজার সিলেট ও চট্টগ্রাম থেকে কার্গো পরিষেবার জন্য দীর্ঘদিনের দাবি পূরণে সরকারের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন।
ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, গত ১৫ মাসে ৪৬ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য (যার অর্ধেকই পোশাক) ভারতের ভেতর দিয়ে রপ্তানি করা হয়েছে। সিলেট বিমানবন্দরে কার্গো পরিষেবা চালু হলে সেগুলো এর মাধ্যমে পরিবহণ করা যাবে। তিনি খরচের ব্যবধান পূরণের জন্য সরাসরি সরকারি সহায়তার আহ্বান জানান।
ভারতের সিদ্ধান্ত বিদ্যমান পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থাকে ব্যাহত করলেও কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি আঞ্চলিক বিমান কার্গো হাব হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগও খুলে দিয়েছে। এই সুযোগটি কাজে লাগাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ঢাকা।