আসামে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তেজনা, পুশব্যাক চলছেই

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে পুশব্যাক শুরু করেছে ভারত। বাংলাদেশি সন্দেহে বহু মানুষকে সীমান্ত পার করানো হচ্ছে, যা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক।
আসামে অতীতে ট্রাইবুনাল যাদের বিদেশি বলে ঘোষণা করেছিল, তাদের ধরার জন্য অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, গত চারদিনে প্রায় ২০০ জনের বেশি মানুষকে আটক করা হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে। তবে পুলিশ এই সংখ্যা সরকারিভাবে জানায়নি।
এর মধ্যে সোমবার দিনগত রাতে উত্তেজনা সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। ওই দিন ১৪ জনকে মানকাছার জেলা সংলগ্ন এক সীমান্ত দিয়ে গোপনে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করে ভারতের সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিএসএফ। এতে বাধা দেয় বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষা বাহিনী, বিজিবি। শুরু হয় বচসা। এক সময় বিএসএফ শূন্যে চার রাউন্ড গুলি চালায় বলেও অভিযোগ। পরে দুই বাহিনীর অফিসারদের মধ্যে বৈঠক হয়। পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে যাদের ভারত থেকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, তারা এখনও দুই দেশের মাঝখানেই ঘোরাফেরা করছেন।
ওই ১৪ জনের মধ্যে আছেন মরিগাঁও জেলার সরকারি বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মো. খায়রুল ইসলাম। তাকে ২০১৬ সালে স্থানীয় এক ট্রাইবুনাল আদালত তাদের একতরফা রায়ে বিদেশি ঘোষণা করেছিল। এরপর তাকে সরকারি চাকরি খোয়াতে হয়। দুই বছর জেল খেটে বাড়ি ফেরার পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিলেন তিনি। ডিসেম্বর মাসে একবার শুনানি হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।
খাইরুল জানান, ২৩ মে মাঝরাতে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পুলিশের গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় গোয়ালপাড়ার মাটিয়ায় থাকা ডিটেনশন ক্যাম্পে। বাংলাদেশের এক ইউটিউবারকে তিনি বলেছেন, “সোমবার রাতে হঠাৎ আমাকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়। আমি বাধা দিলে তারা আমার হাত বেঁধে বেধরক মারধর করে। এরপর জোর করে রাতের অন্ধকারে সীমান্তে থাকা ফেন্সিংয়ের গেট খুলে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়। আমার সঙ্গে আরও ১৩ জন মানুষকেও একইভাবে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এবার আমরা দুই দেশের মধ্যে থাকা জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছি। আমরা আতঙ্কিত কারণ দুই দেশের সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী যখন-তখন আমাদের ওপর গুলি চালাতে পারে।”
খাইরুলের মতো আসামের আরও অনেক মানুষকে ঘোষিত বিদেশি বা সন্দেহজনক নাগরিক হিসেবে রাজ্যের বিভিন্ন থানায় ডেকে পাঠানো হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ গভীর রাতে গিয়ে বাড়ি থেকে তুলে আনছে তাদের। কাছাড় জেলার কমরুল ইসলাম লস্কর নামের এক ব্যক্তিকে একইভাবে রাত দুটোয় তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। যদিও ২০২২ সালে গুয়াহাটি হাইকোর্ট পুলিশ বিভাগকে বলেছিল, তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। তবু জিজ্ঞাসাবাদের নামে প্রায় দুদিন তাকে আটকে রাখে পুলিশ।
কাছাড় জেলার পুলিশ সুপার নুমাল মাহাত্তা ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, “এ নতুন কোনও ঘটনা নয়। ঘোষিত ও সন্দেহজনক বিদেশিদের এভাবে ডেকে নথিপত্র যাচাই করা হয়।”
তবে আটক হওয়াদের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, কারও নথি যাচাই করতে হলে মাঝরাতে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যেতে হয় না। এর পেছনে অন্য ষড়যন্ত্র আছে।
আসাম সরকার গত শনিবার বিদেশি ধরপাকড়ের এক নতুন অভিযান শুরু করে। গুয়াহাটি, ধুবড়ি, মরিগাও, কাছাড়, শ্রীভূমি, মানকাছার, গোলাঘাট, শোনিতপুর ইত্যাদি জেলা থেকে এখন পর্যন্ত ২০০ জনের বেশি লোককে আটক করা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। এদের মধ্যে কিছু কিছু মানুষকে পাঠানো হয়েছে মাটিয়ার ডিটেনশন ক্যাম্পে।
মানকাছার জেলার ঠাকুরনবাড়ি এলাকা দিয়ে যে ১৪ জন ব্যক্তিকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে পাঁচ জন নারীও আছেন। তারা জানান, নথিপত্রের গরমিল বা খানিকটা অভাবের জন্য ট্রাইবুনাল আদালত তাদের বিদেশি ঘোষণা করলেও এভাবে মাঝরাতে অন্য দেশে ঠেলে দেওয়ার কোন নির্দেশ আদালত দেয়নি। সমাজকর্মী কমল চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, “নতুন করে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে এবং এবার পরিকল্পনা একটু আলাদা। তবে বিদেশের সমস্যা সমাধানে এভাবে একতরফা রায়ে নাগরিকত্ব হারানো মানুষদের বাংলাদেশে পাঠানো বোকামি। ওই দেশের সরকার এই মানুষদের গ্রহণ করবে না।”
মানকাছার জেলা সংলগ্ন ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে অশান্তির পর বিএসএফের তরফে মঙ্গলবার বলা হয়, “সোমবার রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আমরা লক্ষ্য করি, একদল মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতের দিকে এগিয়ে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করেন। আমরা তাদের ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি এবং পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক।”
বাংলাদেশের এক ইউটিউবারের দাবি, বিএসএফ যাদের বাংলাদেশি বলে জানিয়েছে, তাদেরকে বিএসএফ কিছুদিন আগে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল। যদিও এই তথ্য নিয়ে ভারতের কোনো সরকারি বয়ান পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি নিয়ে আসামের সরকার বা পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কিছুই বলছেন না। তবে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এর বিরোধিতা করছে। আবার সারা আসাম ছাত্র সংগঠন (আসু) সহ বিভিন্ন স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এর সমর্থনও করছে।
উল্লেখ্য, ১৯৮০-র দশকে আসামে যে ‘বাঙালি খেদাও’ আন্দোলন হয়েছিল, তার পুরোভাগে ছিল আসু। সেই সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেছেন, “এখন মাত্র ১৫০ বা ২০০ জনকে আটক করা হয়েছে বলে শুনেছি। তবে আমাদের হিসেবে আসামে লক্ষাধিক অবৈধ বাংলাদেশি গোপনে বাস করছেন। প্রত্যেককে চিহ্নিত করে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।”
করিমগঞ্জ জেলার এক ট্রাইবুনাল আদালতের সাবেক বিচারক তথা আইনজীবী শিশির দে ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, “এ ঘটনা প্রথম ঘটছে না, অতীতেও আসামের পুলিশ এভাবেই সন্দেহজনক বিদেশিদের ভারতের সীমান্তের বাইরে ঠেলে দিয়েছে। তবে তখন কাঁটাতারের বেড়া ছিল না, ফলে ওই ব্যক্তিরা পরে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পেরেছেন।”
শিশির দে আরও বলেন, “এক দেশের লোক অন্য দেশে নথিপত্র ছাড়া ঢুকে পড়লে তাদের আটক করে এক বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে ফেরত পাঠাতে হয়। এখন যাদের সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তারা আদৌ বাংলাদেশ থেকে এসেছেন কিনা, সেই দেশ তাদের ফেরত নিতে চাইছে কিনা, এই বিষয়গুলো না দেখে রাতের অন্ধকারে কাউকে অন্য দেশে ঠেলে দেওয়া মানবাধিকারের পরিপন্থী।”
শনিবার আসামের নুমালিগড় এলাকায় একসঙ্গে ২২ জন সন্দেহজনক বাংলাদেশিকে আটক করা হয়েছিল। মঙ্গলবার রাতে কাছার জেলার কাটিগড়া এলাকায় স্থানীয় মানুষেরা ৩০ জন ব্যক্তিকে আটক করে রাখেন। পরে তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পুলিশ জানিয়েছে, ওই ব্যক্তিদের আপাতত আটক করে রাখা হয়েছে এবং জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। গোটা রাজ্যে একের পর এক ঘটনায় এক উত্তপ্ত বাতাবরণ তৈরি হয়েছে।
এদিকে দ্য ডেইলি স্টার তাদের এক রিপোর্টে জানিয়েছে, চলতি মাসে এখনো পর্যন্ত ভারত থেকে ৫২৮ জনকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। বিএসএফ বা পুলিশকে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলেও এখনো পর্যন্ত কেউ কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা জানায়নি। অন্যদিকে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সমাজমাধ্যমে একটি তথ্য দিয়েছেন, তার দাবি, গত বছর আগস্ট থেকে এখনো পর্যন্ত আসাম থেকে শতাধিক বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তবে ওই ব্যক্তিদের কাগজ সমেত বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রীর অফিস থেকে দাবি করা হয়েছে।
এখন যাদের আটক করা হচ্ছে, তাদের বাংলাদেশ থেকে আসার প্রমাণ নেই। ফলে সে দেশ তাদের গ্রহণ করবে কিনা, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে এই মানুষেরা এখন কোথায় থাকবেন?