শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারে ৩০ দফা প্রস্তাবনা পেশ করল ছাত্রশিবির

পাঠ্যক্রম, শিক্ষানীতি, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, উচ্চশিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, দক্ষতা, মূল্যায়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও বিবিধ বিষয়ে মোট ৩০ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম এই প্রস্তাবনা পেশ করেন।
শিবির সভাপতি বলেন, ১৯৪৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আধিপত্যবাদ, জুলুম ও ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে যারা জীবন দিয়েছেন, জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানে যারা জীবন ও রক্ত দিয়ে আমাদের নতুন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন, তাদের সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁদের ত্যাগকে কবুল করুন। আহত ও পঙ্গুত্ববরণকারীদের দ্রুত সুস্থতা দান করুন। আমিন।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ, কল্যাণমুখী ও সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে পুনর্গঠন করা অপরিহার্য।
শিবির সভাপতি তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, ১৯৪৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক বিভাজন ও স্বাধীনতার পর ৫৪ বছর ধরে মানুষের মৌলিক ভাগ্যের পরিবর্তন না হওয়ায় একটি অকার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংঘটিত ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান ‘জুলাই বিপ্লব’ নতুন জাতিরাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তবে দুঃখজনকভাবে, শিক্ষা সংস্কারের বিষয়ে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে না।
জাহিদুল ইসলাম উল্লেখ করেন, ১৯৭২ সালের ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন থেকে শুরু করে ২০১০ সালের শিক্ষানীতি পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে প্রণীত শিক্ষানীতিগুলো দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ইসলামিক মূল্যবোধের পরিপন্থি ছিল।
জাহিদুল ইসলাম আরও বলেন, পতিত ফ্যাসিবাদী সরকার ২০১০ সালে একটি একপাক্ষিক ও দুরভিসন্ধিমূলক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে, যার পূর্ণ বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০২২ সালে। উক্ত শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষার মূলোৎপাটন করার নীল নকশা গৃহীত হয়। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তারা ইসলামি শিক্ষাকে বিকৃত করে তদস্থলে শিরক ও বিদআতের মতো ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোকে পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করে।
ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতনের পর ক্ষমতাপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তী সরকার গণআকাঙ্খার ভিত্তিতে একটি কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ণের উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে সকলের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সরকার তা না করে উল্টো ফ্যাসিবাদের তৈরি ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়, যা জনগণকে ভীষণভাবে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করে তোলে। ফলে তীব্র জনরোষের মুখে সরকার এই বিকৃত শিক্ষাক্রমকে স্থগিত ঘোষণা করে ও অতি বিতর্কিত অংশগুলো বাদ দিয়ে একটি অস্থায়ী পাঠ্যসূচি প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত জাতিগঠনের জন্য একটি পরিপূর্ণ পাঠ্যক্রম প্রণয়ন অত্যাবশ্যকীয় ও এটি অগ্রাধিকারমূলক জাতীয় কর্মসূচির অন্তর্ভূক্ত।
শিবির সভাপতি বলেন, একটি মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত, যার মাধ্যমে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধকে সব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ইসলামি আদর্শই হলো একমাত্র সমাধান, যা সকল মানুষকে সমানভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, একটি যুগোপযোগী ও বিশ্বমানের জাতি গঠনের জন্য শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জিডিপির ২ শতাংশেরও কম, যা ইউনেস্কোর সুপারিশ (৬ শতাংশ) ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুরে শিক্ষাখাতে জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১৭-২০ শতাংশ, ভারতে ১৩-১৭ শতাংশ এবং চীনে ১০-১৩ শতাংশ ব্যয় করা হয়।
জাহিদুল ইসলাম বিশ্বাস করেন, এই ৩০ দফা সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত হলে শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটি দূর হবে ও এর মাধ্যমে সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি হবে।
৩০ দফা প্রস্তাবনার সারসংক্ষেপ
ছাত্রশিবিরের পেশ করা ৩০ দফা প্রস্তাবনায় শিক্ষানীতি, পাঠ্যক্রম, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য কিছু প্রস্তাব হলো :
সংস্কার প্রস্তাবনা–১ : অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা কমিশন গঠন
সংস্কার প্রস্তাবনা–২ : জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তকরণ
সংস্কার প্রস্তাবনা–৩ : ইসলামী মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সমন্বয়ে আধুনিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন
সংস্কার প্রস্তাবনা—৪ : বহুমাত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ
সংস্কার প্রস্তাবনা–৫ : বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত শিক্ষায় (এসটিইএম) অগ্রাধিকার প্রদান
সংস্কার প্রস্তাবনা–৬ : ভাষা শিক্ষা সংক্রান্ত
সংস্কার প্রস্তাবনা–৭ : সামরিক ও শারীরিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ
সংস্কার প্রস্তাবনা–৮ : শিক্ষা বাজেট অগ্রাধিকার
সংস্কার প্রস্তাবনা–৯ : শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক স্কুলিং পদক্ষেপ
সংস্কার প্রস্তাবনা–১০ : উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন
সংস্কার প্রস্তাবনা–১১ : স্বাধীন ও স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন গঠন
সংস্কার প্রস্তাবনা–১২ : নারী শিক্ষার প্রসারে উপর্যুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ
সংস্কার প্রস্তাবনা–১৩ : শিক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
সংস্কার প্রস্তাবনা–১৪ : শিক্ষার্থীদের জন্য শতভাগ আবাসন নিশ্চিত ও ব্যবস্থাপনায় আধুনিকীকরণ
সংস্কার প্রস্তাবনা–১৫ : মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও কাউন্সেলিং ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ
সংস্কার প্রস্তাবনা–১৬ : শিক্ষার্থী বান্ধব শিক্ষাঙ্গণ বাস্তবায়ন
সংস্কার প্রস্তাবনা–১৭ : যোগ্য ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ গঠন
সংস্কার প্রস্তাবনা–১৮ : গবেষণামুখী উচ্চশিক্ষা
সংস্কার প্রস্তাবনা–১৯: মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা সংক্রান্ত
সংস্কার প্রস্তাবনা–২০ : কারিগরি শিক্ষার মান বৃদ্ধি
সংস্কার প্রস্তাবনা–২১ : মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কার
সংস্কার প্রস্তাবনা–২২ : শিক্ষক প্রশিক্ষণ কাঠামোর আধুনিকায়ন
সংস্কার প্রস্তাবনা–২৩ : শিক্ষক মূল্যায়নের কার্যকর পদ্ধতি প্রবর্তন
সংস্কার প্রস্তাবনা–২৪ : চাকরিতে সমান সুযোগ ও ন্যায়ভিত্তিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ
সংস্কার প্রস্তাবনা–২৫ : ছাত্ররাজনীতির যথাযথ চর্চা ও নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন আয়োজন
সংস্কার প্রস্তাবনা–২৬ : বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ
সংস্কার প্রস্তাবনা–২৭ : পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মূলধারার শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তকরণ
সংস্কার প্রস্তাবনা–২৮ : কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে বেকারত্ব হ্রাস
সংস্কার প্রস্তাবনা–২৯ : উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার উন্নয়ন ও সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ
সংস্কার প্রস্তাবনা–৩০ : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবক-অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ