হাসিনাকে নির্বাচনের আগের রাতে ৫০ শতাংশ ব্যালট বাক্স ভর্তির পরামর্শ দেন জাবেদ পাটোয়ারী

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, ‘জাবেদ পাটোয়ারী। আমি জানতে পারি, তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ৫০ শতাংশ ব্যালট ভর্তি করে রাখার পরামর্শ দেন। সরকারের পক্ষ থেকে সে মোতাবেক ডিসি, এসপি, ইউএনও, এসিল্যান্ড, ওসি এবং দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী উপরোক্ত কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তা বাস্তবায়ন করেন।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে আজ মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) ক্যামেরা ট্রায়ালে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন আবদুল্লাহ আল মামুন।
জবানবন্দিতে রাজসাক্ষী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমি সাবেক আইজিপি। বর্তমানে অবসরে। এই মামলায় আসামি হিসেবে জেল হাজতে আছি। আমি ১৯৮৬ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৮৯ সালে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করি। আমি আইজিপি হওয়ার পূর্বে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি, সিআইডির প্রধান, র্যাব মহাপরিচালক এবং সর্বশেষ আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট পর্যন্ত আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। আমাকে এই মামলায় গ্রেপ্তারের পর আমি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানে ইচ্ছুক হলে গত ২৪ মার্চ তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে বিজ্ঞ অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন মেজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসেনের কাছে পাঠান। আমি সেদিনই তার কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করি। এই সেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি (প্রদর্শনী-১৫)। জবানবন্দির প্রতি পৃষ্ঠায় আমার স্বাক্ষর আছে। এগুলো আমার স্বাক্ষর (প্রদর্শনী-১৫/১ সিরিজ)। পরবর্তীতে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের পর আমি দোষ স্বীকার করে পুর্ণাঙ্গ সত্য প্রকাশের অঙ্গিকার করে এপ্রভার (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করি। ট্রাইব্যুনাল সে আবেদন মঞ্জুর করেন। আমি আজকে পুর্ণাঙ্গ সত্য প্রকাশের অঙ্গিকার পূরণের লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদান করছি।’
আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমি সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমার বাবা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৯০ সালে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০২৩ সালের ১১ জানুযারি আমার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। আমাকে প্রথমে দেড় বছর এবং পরে আরও এক বছর আইজিপি হিসেবে এক্সটেনশন দেওয়া হয়। আইজিপি পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হওয়ার জন্য সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে গোপালগঞ্জ কেন্দ্রিক গ্রুপিং ছিল। এই গ্রুপিং যাতে প্রকাশিত না হয় এবং পুলিশের সুনাম রক্ষার্থে আমাকে গোপালগঞ্জ কেন্দ্রিক বলয় তৈরি হয়। পুলিশ অফিসাররা বিভিন্ন রাজনৈতিক এক্সটেনশন দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে নির্বাচনের পর পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক রাজনৈতিক মেরুকরণ হয় এবং কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে এবং সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে পড়ে। এসব কারণে সিনিয়র অফিসারদের পক্ষে পুলিশকে কন্ট্রোল করার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। ২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় আমি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ছিলাম। তখন আইজিপি ছিলেন জাবেদ পাটোয়ারী। আমি জানতে পারি, তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ৫০ শতাংশ ব্যালট ভর্তি করে রাখার পরামর্শ দেন। সরকারের পক্ষ থেকে সে মোতাবেক ডিসি, এসপি, ইউএনও, এসিল্যান্ড, ওসি এবং দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী উপরোক্ত অফিসার ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তা বাস্তবায়ন করেন। যে পুলিশ অফিসাররা এসব নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করে তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপিএম, পিপিএম পদক প্রদানের মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয়।’
‘২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পুলিশে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায়। কিছু কিছু পুলিশ অফিসার প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তাদের সঙ্গে ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং রাজনৈতিক নেতাদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় প্রায়ই রাতের বেলায় বৈঠক করত এবং তা গভীর রাত পর্যন্ত চলত। যেসব পুলিশ অফিসার ঐসব বৈঠকে অংশগ্রহণ করতেন, তাদের মধ্যে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবির এডিশনাল কমিশনার হারুন অর রশীদ, এসবির এডিশনাল আইজিপি মনিরুল ইসলাম, ঢাকার ডিআইজি নুরুল ইসলাম, এডিশনাল ডিআইজি বিপ্লব কুমার, এডিশনাল এসপি কাফি, ওসি মাজহার, ওসি ফরমান, ওসি অপূর্ব হাসানসহ আরও বেশকিছু অফিসার ছিল। তাদের কারও কারও সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকার কারণে এই পুলিশ অফিসাররা চেইন অব কমান্ড মানত না। কিন্তু আমি চাইতাম, তারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুক। প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে মূলত দুটি গ্রুপ ছিল। একটি গ্রুপের নেতৃত্বে ছিল তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্বে ছিল তৎকালীন এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম। তারা চাইতেন তাদের নিজস্ব বলয়ের লোকজন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং পাক এবং ঢাকায় থাকুক’, যোগ করেন সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন।
রাজসাক্ষী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি র্যাবের ডিজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় আমি জানতে পারি, র্যাবের হেড কোয়ার্টার কর্তৃক পরিচালিত উত্তরাস্থ র্যাব-১ এর কমপাউন্ডের ভেতরে টিএফআই সেল (টাস্ক ফোর্স ইন্টারোগেশন সেল) নামে একটি বন্দিশালা ছিল। অন্যান্য র্যাব ইউনিটের অধীনে আরও অনেকগুলো বন্দিশালা ছিল। এসব বন্দিশালায় রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে উঠা ব্যক্তিদেরকে আটক রাখা হতো, নির্যাতন করা হতো; যা একটি কালচারে পরিণত হয়েছিল। অপহরণ, গোপন বন্দিশালায় আটক, নির্যাতন এবং ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হত্যার মতো কাজগুলো র্যাবের এডিজি (অপস/অপারেশন) এবং র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের (র্যাব ইন্ট/ইন্টেলিজেন্স) পরিচালকরা সমন্বয় করতেন। র্যাব কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা, আটক রাখা কিংবা হত্যা করার নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত বলে শুনেছি। এই নির্দেশনাগুলো তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দীকির মাধ্যমে আসতো বলে জানতে পারি। এই নির্দেশনাগুলো চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে সরাসরি এডিজি (অপস) এবং র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের (র্যাব ইন্ট) পরিচালকদের কাছে পাঠানো হতো। আমি র্যাবের ডিজি হিসেবে যোগদানের সময় আমার পূর্ববর্তী র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহম্মেদ আমাকে জানান, টিএফআই সেলে ব্যরিস্টার আরমান বন্দি আছে। আমি যোগদানের পরে র্যাব ইন্টের ডাইরেক্টর লেফটেনেন্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেমও আমাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। র্যাবের এডিজি (অপস) এবং র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগে (র্যাব ইন্ট) সাধারণত সেনাবাহিনীর অফিসার থেকে নিয়োগ করা হতো। টিএফআই সেলে ব্যরিস্টার আরমানের বন্দি থাকার বিষয়টি তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রীর সামরিক ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের কাছে একাধিকবার উপস্থাপন করি এবং এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানতে চাই। তিনি আমাকে পরে জানাবেন মর্মে অবহিত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি আর কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি। আমি র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিয়ে আসার সময় পরবর্তী মহাপরিচালক খুরশীদ হোসেনকে ব্যরিস্টার আরমানের বিষয় সম্পর্কে অবহিত করি। র্যাবে অফিসারদের মধ্যে এডিশাল এসপি আলেপ উদ্দিন ও এসপি মহিউদ্দিন ফারুকী নামে দুজন অফিসারকে আমি চিনতাম, যারা বন্দিদের অপহরণ, নির্যাতন এবং হত্যার মতো কাজে বিশেষ পারদর্শী ছিল।’
‘আলেপ উদ্দিন প্রথমে নারায়ণগঞ্জে ছিল। পরবর্তীতে র্যাবের এডিজির (অপস) প্রস্তাবমতে তাকে র্যাব ইন্টে পদায়ন করা হয়। আমি র্যাব ডিজির দায়িত্বপালন করাকাকালে র্যাবের ডাইরেক্টর ইন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম, লে. কর্নেল খাইরুল ইসলাম ও লে. কর্নেল মশিউর রহমান। এ ছাড়া এডিজি (অপস) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কর্নেল তোফায়েল, কর্নেল আজাদ ও কর্নেল কামরুল। আমার দায়িত্ব পালনকালে যদিও আমি র্যাব কর্তৃক মানুষকে বিনা বিচারে আটক, নির্যাতন এবং কাউকে কাউকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার মতো বিষয়গুলো জানতাম, কিন্তু আমি কোনো তদন্ত করিনি বা এগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্তগুলো বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আসত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে চেইন অব কমান্ড মানা হতো না। র্যাবের এসব কার্যক্রমের ফলে আমেরিকা স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক র্যাব বাহিনীর ওপরে এবং আমিসহ সাবেক কয়েকজন র্যাব কর্মকর্তার ওপর স্যাংশন আরোপ করা হয়। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দেশব্যাপী সেনা মোতায়েন হয়’, যোগ করেন আবদুল্লাহ আল মামুন।
আবদুল্লাহ আল মামুন আরও বলেন, ‘এরপর ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতেই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ধানমণ্ডিস্থ সরকারি বাসায় কোর কমিটির মিটিং হতো। সেখানে আমাদেরকে আন্দোলন দমনসহ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হতো। কোর কমিটিতে আমিসহ সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাংগীর আলম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) টিপু সুলতান, অতিরিক্ত সচিব রেজা মোস্তফা, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, র্যাব ডিজি ব্যরিস্টার হারুন অর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিজি বিজিবি মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দীকি, ডিজি আনসার মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক, এনটিএমসির প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, ডিজিএফআই প্রধান ও এনএসআই প্রধানরা উপস্থিত থাকতেন।’
সাক্ষীর জবানবন্দিতে আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “কোর কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটক করার সিদ্ধান্ত হয়। ডিজিএফআই এই প্রস্তাব দেয়। আমি বিরোধিতা করেছিলাম, কিন্তু স্বরাষ্টমন্ত্রীর নির্দেশে আমি রাজি হই। ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বরাষ্টমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডিজিএফআই ও ডিবি তাদেরকে আটক করে ডিবি হেফাজতে নিয়ে আসে। তাদেরকে ডিবি হেফাজতে এনে আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আপস করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। তাদের আত্মীয়-স্বজনকেও ডিবিতে নিয়ে এসে উক্তরূপ চাপ প্রদান করা হয়। সমন্বয়কদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে টেলিভিশনে বিবৃতি প্রদানে বাধ্য করা হয়। এ ব্যাপারে ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ডিবি প্রধান হারুনকে স্বরাষ্টমন্ত্রী ‘জিন’ বলে ডাকতেন। কারণ সে সরকারের নির্দেশনা পালনে পারদর্শী ছিল।”
‘আন্দোলনের একপর্যায়ে হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নজরদারি, তাদের অবস্থান নির্ণয় ও গুলি করে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করা হয়। হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে, যার পরামর্শ দিয়েছিলেন তৎকালীন র্যাবের মহাপরিচালক ব্যরিস্টার হারুন অর রশিদ। পরবর্তীতে আন্দোলন দমনে সরাসরি লেথাল উইপন ব্যবহার করে এবং আন্দোলনপ্রবন এলাকাগুলো ভাগ করে ব্লকরেইড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমাকে ফোন করে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলন দমনে সরাসরি লেথাল উইপন ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। তখন আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত ছিলাম এবং আমার সামনে অতিরিক্ত ডিআইডি প্রলয় জোয়ার্দার উপস্থিত ছিলেন। আমি প্রলয় জোয়ার্দারকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানালে সে আমার রুম থেকে বের হয়ে ডিএমপি কমিশনারসহ সারা দেশে এই নির্দেশনা পৌঁছে দেয়। এই নির্দেশনা দেন ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই এবং ঐ দিন থেকেই লেথাল উইপন ব্যবহার করা শুরু হয়। উক্ত নির্দেশনা অনুযায়ী ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান তার অধীনস্ত কর্মকর্তাদের লেথাল উইপন ব্যবহারের নির্দেশনা দেন। লেথাল উইপন ব্যবহারের বিষয়ে অতি উৎসাহী ছিলেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ। স্বরাষ্টমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল—যেকোনো মূল্যে আন্দোলন দমন করতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মির্জা আজম, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন প্রধানমন্ত্রীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারে প্ররোচিত করতেন’, যোগ করেন আবদুল্লাহ আল মামুন।
সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৪ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর শেষে দেশে এসে একটি সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিপুতিরা চাকরি পাবে না তবে কি রাজাকারের সন্তান ও নাতিপুতিরা চাকরি পাবে? এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার মধ্যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং সমগ্র দেশে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। অতঃপর ১৫ জুলাই ওবায়দুল কাদের, নানক মন্তব্য করেন, আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রলীগ ও যুবলীগই যথেষ্ট। এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন পুলিশ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ড্রোন, হেলিকপ্টার ও লেথাল উইপন ব্যবহার করে আন্দোলনরত অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে আহত ও নিহত করা হয়। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্যাডার বাহিনী ছাড়াও আন্দোলন দমনে সরকারকে উৎসাহিত করে আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও ব্যবসায়ীরা।’
আবদুল্লাহ আল মামুন আরও বলেন, ‘২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বেলা ১১টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির একটি বৈঠক হয়। উক্ত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও যারা যারা উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন—আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, এসবির প্রধান, ডিজিএফআইয়ের প্রধান, এনএসআইয়ের প্রধানসহ মোট ২৭ জন। আমি নিজেও ঐ বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম। ঐ বৈঠকে আন্দোলন দমন এবং নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরিস্থিতির রিপোর্ট পেশ করছিল। ইতিমধ্যে চারদিকে পরিবেশ পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হওয়ায় বৈঠকটি মুলতবি করা হয়। ৪ আগস্ট রাতের বেলায় আমাদেরকে আবার গণভবনে ডাকা হয়। সেখানে আমি, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্টমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের ডিজি, লে. জেনারেল মুজিব উপস্থিত ছিলাম। ঐ সময় প্রধানমন্ত্রী ও তার বোন শেখ রেহানা উপস্থিত ছিল। ডিজিএফআই প্রধান ও এসবি প্রধান মনিরুল বাইরে অপেক্ষমান ছিল। ঐ বৈঠকে ৫ আগস্ট আন্দোলনরত ছাত্রজনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, পুলিশ ও সেনাবাহিনী সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করবে। এরপর আমরা আর্মির অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যাই। সেখানে আমি, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্টমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের ডিজি, লে. জেনারেল মুজিব, ডিজিএফআই প্রধান ও এসবি প্রধান মনিরুল, ডিএমপি কমিশনার উপস্থিত ছিলাম। সেখানে ঢাকা শহরের প্রবেশ মুখগুলোতে ফোর্স মোতায়েন করে কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মিটিং শেষে রাত সাড়ে ১২টায় আমরা আর্মির অপারেশন কন্ট্রোল রুম থেকে চলে আসি।’
‘২০২৪ সালের ৫ জুলাই সকালে আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আমার দপ্তরে যাই। ইতোমধ্যে উত্তরা, যাত্রাবাড়ী এবং বিভিন্ন পথ দিয়ে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে শুরু করে। দুপুর ১২টা থেকে ১টার দিকে জানতে পারি, প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি কোথায় যাবেন তা আমরা জানতাম না। এরপর বিকেলে আর্মি হেলিকপ্টার এসে আমাদেরকে পুলিশ হেডাকোয়ার্টার্স থেকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে এবং সেখান থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। হেলিকপ্টারে আমার সঙ্গে এসবি প্রধান মনিরুল, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিআইজি আমেনা ছিলেন। পরের শিফটে এডিশনাল ডিআইজি প্রলয়, এডিশনাল আইজি লুৎফুল কবিরসহ অন্যান্যদেরকে সেখানে নিয়ে আসা হয়’, যোগ করেন সাবেক এই আইজিপি।
আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘২০২৪ সালের ৬ আগস্ট আইজিপি হিসেবে আমার নিয়োগ চুক্তিটি বাতিল করা হয়। ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকালে ৩ সেপ্টেম্বর আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
আবদুল্লাহ আল মামুন আরও বলেন, “আন্দোলন চলাকালে ২০২৪ সালের ২৭ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব, ডিএমপি কমিশার ও আমিসহ আন্দোলনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য নারায়ণগঞ্জ যাই। যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আমরা কিছুক্ষণ অবস্থান করি। সে সময় ওয়ারী জোনের ডিসি ইকবাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মোবাইলে একটি ভিডিও প্রদর্শন করেন। সেই ভিডিও দেখিয়ে ইকবাল বলে, ‘গুলি করি একজন মরে, একজন আহত হয় সে-ই যায়, বাকিরা যায় না’। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকারের আদেশে আন্দোলনকারীদের ওপর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে তাদেরকে আহত ও নিহত করায় আমি পুলিশ প্রধান হিসেবে লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাসহ ব্যাপক নৃশংসতার জন্য আমি অপরাধবোধে এবং বিবেকের তাড়নায় আমি এপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ট্রাইব্যুনালে এসে স্বজন হারানো মানুষের কান্না আহাজারি শুনে, চিকিৎসা প্রদানে বাধা দেওয়া সংক্রান্ত ডাক্তার এবং ভিক্টিমদের বক্তব্য, ভিডিওতে নৃশংসতাগুলো দেখে আমি এপ্রভার হওয়ার সিদ্ধান্ত আরও যৌক্তিক মনে হয়েছে। বিশেষ করে হত্যা করার পর লাশগুলো একত্রিত করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার বীভৎসতা আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে। আমি সাড়ে ৩৬ বছর পুলিশে চাকরি করেছি। পুলিশের চাকরি খুবই ট্রিকি চাকরি। সবসময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। আমার এই চাকরি জীবনে আমার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ আসেনি। আমি সবসময় যথেষ্ট মানবিকতা ও সচেতনার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। চাকরি জীবনের শেষপর্যায়ে এসে এত বড় গণহত্যা আমার দায়িত্বকালে সংঘটিত হয়েছে তার দায় আমি স্বীকার করছি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়। আমি গণহত্যার শিকার প্রত্যেক পরিবার, আহত ব্যক্তি, দেশবাসী এবং ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।” সাক্ষী এ পর্যায়ে আবেগপ্রবণ ও অশ্রুসজল হয়ে পড়েন। এরপর তিনি বলেন, ‘আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন। আমার এই সত্য ও পূর্ণাঙ্গ বর্ণনার মাধ্যমে সত্য উদঘাটন হলে আল্লাহ যদি আমাকে আরও হায়াত দান করেন, বাকি জীবনটা কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাব।’