করহার খুব বেশি কমানোর সুযোগ নেই

করমুক্ত আয়ের সীমা পাঁচ লাখ টাকা করাসহ সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ রাখার দাবি জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) নেতার। একইসঙ্গে তারা অটোমেটেড করপোরেট কর রিটার্ন পদ্ধতি চালুর করার দাবি করেন। এছাড়া ভ্যাট সংগ্রহ অনলাইনের পাশাপাশি মোবাইল অ্যাপ তৈরি, রেয়াত সুবিধা, আয়কর আইন সংশোধন, আমাদানি পর্যায়ে আগাম কর উৎপাদনকারীদের জন্য বিলুপ্তিসহ অনানুষ্ঠিনিক খাতের ভ্যাট এক শতাংশ করার দাবি তাদের।
আজ রোববার (১৩ এপ্রিল) হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ডিসিসিআই, দৈনিক সমকাল এবং চ্যানেল২৪-এর যৌথ উদ্যোগে ‘প্রাক-বাজেট আলোচনা ২০২৫-২০২৬: বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় ডিসিসিআইর নেতারা এসব দাবি রাখেন। সভায় সভাপতিত্বে করেন ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ।
আয়কর বেশি কমানোর সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। তিনি বলেন, কর বেশি কমালে সরকারের রাজস্ব আদায় কমে যাবে। তাতে দেশ চালানো কঠিন হবে। সেই বাস্তবতায় কর বেশি কমাতে পারব না, তবে চেষ্টা থাকবে। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, কোম্পানি লোকসান করলেও কর দিতে হয়, সেখানে নতুন বাজেটে কিছু করার চেষ্টা থাকবে। অন্যদিক আমদানিতে শুল্কহার কমানো হবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বিক শুল্কহার যৌক্তিকীকরণ করা হবে।
স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিধারা অব্যাহত রাখতে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিকল্পে করজাল সম্প্রসারণ এবং কর ব্যবস্থাপনার সহজ করা আবশ্যক। এছাড়া অটোমেটেড করপোরেট কর রিটার্ন পদ্ধতি চালু, আমদানি পর্যায়ে আগাম কর উৎপাদনকারীদের জন্য বিলুপ্তি ও বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের জন্য হ্রাস করা, অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য এক শতাংশ এবং অন্যদের জন্য ভ্যাটের হার সিঙ্গেল ডিজিট নির্ধারণের দাবি করেন।
ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, স্থানীয় ও বৈশ্বিক বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ঋণের সুদহার কমানো, ঋণ শ্রেণিবদ্ধকরণের সময়সীমা আরও ছয় মাস পেছানো ও সব শিল্পের জন্য অন্তত ছয় মাস মোরাটিরিয়াম সুবিধা প্রদান, মন্দ ঋণ হ্রাসে আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সিএমএসএমই খাতের অর্থায়নের শর্তাবলীর সহজীকরণ এবং দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের লক্ষ্যে পুঁজিবাজারে ইক্যুইটি ভিত্তিক শেয়ার নীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের এলডিসি গ্রাজুয়েশন এবং শিল্পায়নের গতিধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে অবকাঠামো ও লজিস্টিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে নির্মাণ উপকরণ ও মেশিনারির উপর শুল্ক এবং ভ্যাট ছাড় নিশ্চিতকরণ, শিল্পখাতে প্রতিযোগীসক্ষম জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের পাশাপাশি নিরবিচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণের উপর জোরারোপ করেন তাসকীন আহমেদ। এছাড়া রপ্তানি আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি, চামড়া, ঔষধ, অটোমোবাইল, হালকা প্রকৌশল ও তথ্য-প্রযুক্তির ন্যায় সম্ভাবনাময় খাতে আসন্ন বাজাটে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।
ইন্টারন্যাশন্যাল চেম্বার অব কমার্স-বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের রপ্তানির উপর শুল্কারোপের প্রসঙ্গে বলেন, সরকারের উচিত এ ব্যাপারে নেগোশিয়েশনের উদ্যোগ নেওয়া এবং ডিসিসিআইসহ বেসরকারিখাতের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা। তিনি বলেন, শুধুমাত্র কর ব্যবস্থাপনাই নয়, শুল্ক কাঠামোকে সম্পূর্ণ অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। মাহবুবুর রহমান বলেন, বাজেট শুধুমাত্র এক বছরের জন্যই নয়, দেশি বিনিয়োগকারীদের আগামী বাজেটে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুবিধা প্রদান করা হলে, আমাদের অর্থনীতিতে তারা অধিক হারে অবদান রাখতে পারবে।
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিনিয়োগ ও ব্যবসার প্রবৃদ্ধি না বাড়লে অর্থনীতি সম্প্রসারিত হবে না, তবে এজন্য সহায়ক নীতিমালা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় সংষ্কার আবশ্যক। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় গলদ রয়েছে, ফলে কাঙ্খিত মাত্রায় ব্যবসা-বাণিজ্যে অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না, কারণ হলো স্বল্পমেয়াদে আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ প্রদান কখনই টেকসই হয় না। বিনিয়োগ সম্প্রসারণের জন্য কার্যকর এবং সহায়ক কর নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি বলে মত দেন।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা বান্ধব বাজেটের কোন বিকল্প নেই। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন যাবত সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি বজায় থাকলে বেসরকারিখাতে প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হবে না। আমাদের উদ্যোক্তারা পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে আর্থিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত করতে আগ্রহী, তবে প্রয়োজন সহায়ক নীতিমালা। এছাড়া রাজস্ব নীতিমালার সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য নীতিসমূহের মধ্যে সমন্বয় থাকা জরুরি বলে তিনি মত দেন। কর-জিডিপির হার বৃদ্ধিকল্পে তিনি টিআইএন থাকা সত্ত্বেও যারা কর প্রদান করেন না, তাদেরকে করের আওতায় নিয়ে আসার উপর জোরারোপ করেন।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, গতানুগতিক ঘাটতি বাজেট এবং সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহ কাঙ্খিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। তিনি সরকারের নিকট হতে একটি ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বান্ধব, অন্তর্ভুক্তিমূলক, বাস্তবমুখী এবং সময়োপযোগী বাজেট প্রত্যাশা করেন। এছাড়া রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে সরকারি ব্যয় হ্রাসে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কর হয়রানি বন্ধ করা গেলে অধিক সংখ্যক মানুষ কর প্রদানে উৎসাহিত হবে।
অনুষ্ঠানের আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), আর্থিক খাত, শিল্প বাণিজ্য এবং অবকাঠামো চারটি সেশনের নির্ধারিত আলোচনা সেশনে আইসএবির সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ ফোরকান উদ্দিন, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান, এনবিআরের সদস্য (আয়কর) এ কে এম বদিউল আলম, উর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ, বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মতিউর রহমান, ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান একেএম হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (গবেষণা) ড. সায়েরা ইউনুস, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম, কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম, বাংলাদেশ ফ্রেইডর্স ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ এবং ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান অংশগ্রহণ করেন।
ডিসিসিআই প্রাক্তন সভাপতি রিজওয়ান রহামান বলেন, বিদ্যমান পরিস্থতির আলোকে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা এলডিসি গ্রাজুয়েশনের জন্য প্রস্তুত নয়, তাই সরকারের আরও ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ইতোমধ্যে লজিস্টিক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, তবে এ খাতের সুফল পেতে হলে দশ বছর মেয়াদী একটি লজিস্টিক মাস্টারপ্ল্যান থাকা প্রয়োজন। এছাড়াও তিনি বন্ড মার্কেটের উন্নয়নের উপর জোরারোপ করেন।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুক্তরাষ্ট্রের ভালো মানের তুলা আমদানি বৃদ্ধিতে ওয়্যার হাউস নির্মান সুবিধা প্রদানের উপর গুরুত্বারোপ করেন, ফলে সেদেশের সাথে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পাবে। এছাড়াও ম্যানমেইড ফাইবারের মতো হাইভ্যালু পণ্য উৎপাদনে উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার উপর তিনি জোরারোপ করেন।
এছাড়া অন্যান্য আলোচকরা বলেন, যৌক্তিকহারে কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, একক ভ্যাট হার নির্ধারণ ও সামগ্রিক রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অটোমেশন, বিদ্যমান অবস্থার আলোকে এলডিসি গ্রাজুয়েশন কিছুটা পেছানো, শিল্পখাতে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন, অগ্রীম কর কর্তন, আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিতকরণ, স্থিতিশীল বিনিময় হার বাস্তবায়ন, ঋণের সুদ হার হ্রাসকরণ, শক্তিশালী বন্ড মার্কেট প্রবর্তন এবং পুঁজিবাজারে আস্থা আনায়নের উপর জোর দেন।