জবি শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ছাত্রীর

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগের শিক্ষক আবু শাহেদ ইমনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন একই বিভাগের এক শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার না পেয়ে বিচার চেয়ে বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে বিচার দাবি করেন ওই শিক্ষার্থী।
ঘটনার বিবরণ উল্লেখ করে ওই ছাত্রী জানান, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ সেশনের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ঘটনার বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে গত ২৬ ডিসেম্বর আবেদন জমা দিয়েছেন। কিন্তু কোন প্রতিকার পাননি তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে একাই দাঁড়িয়ে বিচার দাবি করেন।
যৌন হয়রানির শিকার ওই ছাত্রী লিখিত অভিযোগ করে বলেন, শিক্ষকরা সবসময় আমার কাছে পিতা-মাতার সমতুল্য এবং বিশ্বস্ত ও নিরাপত্তার অঢেল ভাণ্ডার। কিন্তু এ আদর্শের ব্যত্যয় ঘটেছে আমার বিভাগের একজন শিক্ষক আবু শাহেদ ইমনের ক্ষেত্রে। কাজের সুবাদে ২০১৯ সালে শিক্ষক আবু শাহেদ ইমনের সঙ্গে তাঁর ফিল্ম প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে আমার সঙ্গে তাঁর ছাত্র-শিক্ষকের মতো আলাপচারিতা হয় কখনো ক্লাসে বা কখনো বিভাগের অফিসে। প্রাথমিকভাবে কোন কাজের আশ্বাস না দিলেও কিছুদিন পর ফোনালাপে তিনি আমাকে জানান, তার সিনেমা বা নাটকের কাজের বিষয়ে প্রডাকশন হাউস অফিসে সামনা-সামনি আলাপের জন্য যেতে হতে পারে। কাজ ও পড়াশুনা ব্যতীত তাঁর সঙ্গে আমার কখনই অন্য কোন বিষয়ে কথোপকথন হয়নি। ২০১৯ সালে ৮ নভেম্বর ক্যাম্পাসে লিট ফেস্টিভ্যাল দেখতে আমার দুই বান্ধবীসহ যাই। ওইদিন শিক্ষক আবু শাহেদ ইমন নিকেতনের ব্লক-এ এর দুই নম্বর রোডের ৮২ নম্বর বাসায় অবস্থিত ব্যক্তিগত কার্যালয়ে যেতে আমাকে ফোন করেন। নাটক বা ছবিতে কাজের বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে যান। সেখানে যাওয়ার পর ওই শিক্ষক নিজেই দরজা খুলে আমাকে ভেতরে আসতে বলেন। তিনি এ সময় একটি ল্যাপটপে কাজ করছিলেন। আমি অপরপ্রান্তে চেয়ারে বসি। প্রাথমিক আলাপের পর তিনি কথার মোড় ঘুরিয়ে বলেন, ‘তোমাকে দেওয়ার মতো কোন কাজ আমার কাছে আপাতত নেই। বরং তুমি চাইলে আমাদের মধ্যে একটি ফ্রেন্ডশিপ হতে পার।’ এ সময় কি ধরনের ফ্রেন্ডশিপ জানতে চাইলে উত্তরে নিজের শরীর হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে দেখিয়ে বলেন, ‘আমাকে দেখে তোমার কি কখনও কিছু অনুভব হয়নি?’ এ কথা বলতে বলতে তিনি নিজের চেয়ার থেকে উঠে আমার চেয়ারের পেছনে এসে যৌন অঙ্গভঙ্গিতে আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে মেসেজ করতে শুরু করেন। তিনি তার যৌন তাড়না প্রকাশ করে বলতে থাকেন ভয় পেয়ো না। এখানে কেউ দেখতে পাবে না। কেউ শুনতেও পাবে না। তাঁর আচরণে আমি ভয় পেয়ে যাই এবং তৎক্ষণাৎ আমার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই আমাকে জোরপূর্বক শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন। আমাকে তার সঙ্গে নোংরা কাজে লিপ্ত হওয়ার জন্য জোর করেন। আমি নিজেকে রক্ষা করতে চিৎকার করে বলতে থাকি, স্যার আপনি যা চাচ্ছেন আমি তা চাচ্ছি না। এরপর আমি পুলিশ ডাকার ভয় দেখালে তিনি আমাকে ছাড়তে বাধ্য হন।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আরও জানান, আমি তার পরের দিন এক সহপাঠীসহ বিভাগীয় চেয়ারম্যানকে এই ঘটনা জানালে তিনি বলেন, ‘উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া বিচার করা সম্ভব না। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া উপাচার্য বরাবর অভিযোগ করলে তা প্রমাণ করতে না পারলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগে ছাত্রত্ব বাতিল হতে পারে।’
এই শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন তার পরবর্তীতে ক্লাসে লাঞ্ছনা, অ্যাসাইনমেন্ট ও উপস্থিতির বৈষম্যের শিকার এবং পরীক্ষার স্বল্প মার্কসের ঘটনা ঘটলে উপাচার্যের কাছে এই বিষয়ে বিচারের জন্য লিখিত অভিযোগ করেন। তার অভিযোগ অন্যান্য সহপাঠীদের প্রলোভন দেখিয়ে এবং কাউকে কাউকে ভয় দেখিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এমনকি যৌন হয়রানির অভিযোগ সেলেও ঘটনার তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে। পরিচালক হিসেবে সুপরিচিত এই শিক্ষক তাঁর আস্থাভাজন হওয়ায় বিভাগীয় চেয়ারম্যান এই বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেননি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকদেরকেও সংবাদ প্রকাশ না করার চাপ দেওয়া হয়। সর্বশেষ বাধ্য হয়ে একাই এই শিক্ষার্থী প্রতিবাদ করতে দাঁড়ান।
অভিযোগের দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনা যখন শুরু তখন আমি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী হওয়ায় অভিযোগ করার সাহস পায়নি।
এ বিষয়ে শিক্ষক আবু শাহেদ ইমন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সে আমার কোর্সের কোনো ক্লাসে অংশ না নিয়ে শেষ ক্লাসে এসে পুরো কোর্স সম্পর্কে জানতে চাইলে তাকে তিরস্কার করি, যা সাধারণভাবে শিক্ষকরা করে থাকেন। এ বিষয়ে যে বাজে অভিযোগ করেছে তা ভিত্তিহীন, কাল্পনিক, উদ্দেশ্যপ্রসূত ও আমলযোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সঠিক তদন্ত করে সত্য ঘটনা তুলে আনবে, এটা আমিও চাই।’
এ বিষয়ে বিভাগীয় চেয়ারম্যান জুনায়েদ আহমদ হালিম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ওই ছাত্রী আমার কাছে মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছে ছয় মাস পর। তাকে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার কথা বলা হলেও সে তা করেনি। সে অসহযোগিতা করছে।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হককে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘অভিযোগ পাওয়ার পর ঘটনাটি তদন্তের জন্য যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সত্যতা পাওয়া গেলে অবশ্যই বিচার হবে।’
বার বার অভিযোগের পরও কেন বিষয়টি সমাধান হয়নি জিজ্ঞেস করলে তিনি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. লাইসা আহমেদ লিসা বলেন, ‘বিষয়টি গোপনীয়। তদন্তের স্বার্থে কারো নাম বলা যাচ্ছে না। আমরা মিটিং করব। তদন্ত হবে। পরবর্তীতে অবশ্যই ফলাফল জানানো হবে।’