পথশিশু
কালু-ধিলুর কথা

খিলগাঁওয়ে জুস আর কফির দোকানগুলোর সামনে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল দুটি ছেলে প্রতিযোগিতা করে কফি আর জুসের পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের গ্লাসগুলো সংগ্রহ করে বস্তায় ভরছে। হঠাৎ তারা আবিষ্কার করল- একটা ফেলে দেওয়া গ্লাস ভরা কোল্ড কফি। কে যেন কিছুটা খেয়েই ফেলে দিয়ে চলে গেছে। তারা দুজন ফুটপাতে বসে সেই কোল্ড কফি খেতে শুরু করল। সেই খাওয়ার অবসরেই তাদের সঙ্গে কথা হলো। নাম জিজ্ঞেস করে জানলাম একজনের নাম ধিলু (১২), অন্যজনের নাম কালু (৭)।
আমি : অই তরা তো বইসা কফি খাইতেছোস। তগো লগে এই ফাঁকে একটু কথা কই। কী কস?
ধিলু (১২) : আচ্ছা কন।
আমি : তগো ছবি আর কথা পেপারে দিমু। এইখানে সুন্দর কইরা খাড়া। কয়টা ছবি তুলি।
ধিলু : না ছবি তুলমু না।
আমি : ক্যান? সমস্যা কি?
ধিলু : ছবি পেপারে উঠলে পুলিশে ধইরা লয়া যাইব।
আমি : যাহ বেকুব। আমারে দেখলে কি পুলিশের মতো দেখা যায়? দাঁড়া তো সুন্দর কইরা, ছবি তুলি।
খুবই আতঙ্কিত চেহারা নিয়ে কালু আর ধিলু ক্যামেরার সামনে দাঁড়াল। এর মধ্যে খেয়াল করলাম, ধিলু বেশ চুপচাপ গোছের। তাকে হাসতে বললেও তার হাসি আসে না। অন্যদিকে কালুর মুখে হাসি লেগেই আছে। ছবি তোলা শেষ করে আবার কথা বলা শুরু করলাম।
আমি : ওই তোরা কি আপন ভাই?
ধিলু : না। কালু আমার খালার পোলা।
আমি- থাকোস কই তোরা?
ধিলু : খিলগাঁ রেললাইন বস্তির অইহানে থাকি।
আমি : কয় বচ্ছর ধইরা অই এলাকায় থাকোস?
ধিলু : অনেক বচ্ছর ধইরা থাকি।
আমি : এই যে রাস্তায় রাস্তায় গ্লাস টোকাস, কোনোদিন কারো মাইর খাইছোস?
ধিলু : হ খাইছি। একবার এক ব্যাডার মোটরসাইকেলের সামনে পড়ছিলাম, পরে ব্যাডায় মাইর দিছিল।
আমি : মোটরসাইকেলের সামনে আবার পড়তে গেলি কোন দুঃখে?
ধিলু : রাস্তা পার হইতে গিয়া মোটরসাইকেলের সামনে পড়ছিলাম।
আমি : কোথাও ব্যথা পাইছিলি?
ধিলু : না। আগেই ব্যাডায় মোটরসাইকেলডা থামায়ে দিছে।
আমি : এ ছাড়া কেউ মারে না?
ধিলু : হ একবার এক খাওনের দোকানের সামনে খাড়ায় আছিলাস, অইসুম দোকানের এক ব্যাডায় এমন জোরতে একটা বাড়ি দিছিল! এক্কেরে ঠোঁট ফুইল্লা গেছেলো।
আমি : যেখানে থাকোস, অইখানে কেউ নেশা করে না?
ধিলু : হ করে।
আমি : তোগো কেউ নেশা করতে কয় না?
ধিলু : আমরা নেশা করি না।
আমি : তোগোর ওইদিকে তোর বয়সী অন্য পোলারা নেশা করে?
ধিলু : হ আছে কয়জন। ওরাও মধ্যে মধ্যে কাগজ-গেলাস টোকায়। আবার মধ্যে মধ্যে নেশা করে।
আমি : কেউ তোগোরে দিয়া নেশার জিনিসপাতি আনায়?
ধিলু : আগে মিজান মামায় কইত। এখন আর কয় না।
আমি : এখন কয় না কেন?
ধিলু : আমি আনি না। আনতে ডর লাগে।
আমি : স্কুলে পড়োস তোরা?
ধিলু : আমি পড়ি না। কালু পড়ে।
আমি : অই কালু, তুই কোন ক্লাসে পড়োস?
কালু : ওয়ানে পড়ি।
আমি : দুইজনে এই প্লাস্টিকের গ্লাস টোকাইয়া ডেইলি কত কামাই করোস?
ধিলু : এক বস্তা গ্লাসের দাম ১০০ টাকা।
আমি : বাপরে বাপ, ডেইলি ১০০ টাকা হইলে মাসে তো ৩০০০ টাকা কামাই করোস। ম্যালা টাকা দেখি। কী করোস এত টাকা দিয়া?
ধিলু : কি আর করমু? মায়রে দিয়া দেই।
আমি : এই ঈদে জামা নিছোস?
ধিলু : এক ব্যাডায় দোকানে নিয়া আমাগো দুইজনেরে প্যান্ট কিন্না দেছে। ওই যে কালুর পেন্দনে যে প্যান্ট, ঐটা ঐ ব্যাডায় দেছে। আমার প্যান্টটা আমি বাসায় থুইয়া দিছি।
আমি : বড় হইয়া কী করবি? এই গ্লাসই টোকাবি নাকি অন্য কিছু করবি?
ধিলু : বড় হইয়া দোকানে কাম করমু।
কালু : আমি বড় হইয়া পেলেন চালামু।
আমি : খালি কামাই করবি? বিয়া-শাদি কিছু করার ইচ্ছা নাই তোগো?
(এই প্রশ্ন শুনে তারা লজ্জা পেল।)
ধিলু : বিয়া করমু কিনা জানি না।
কালু : বিয়ার কথা কমুনা। শরম ধরে।
তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে খেয়াল করলাম তারা দুজনেই বেশ সহজ হয়ে গিয়েছে। ব্যাগে কিছু চকলেট ছিল। সেগুলো বের করে তাদের হাতে দিতেই তাদের মুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠল। বিদায় নেওয়ার সময় ধিলু তার বাসায় নিমন্ত্রণও করল। রিকশায় না ওঠা পর্যন্ত তারা তাকিয়ে রইল যেন অনেক আপনজনকে বিদায় দিচ্ছে তারা।