সিঙ্গাপুরে চুইং গাম নিষিদ্ধ যে কারণে

চুইং গাম! সাদা, লাল, গোলাপি, সবুজ, নীল বাহারি রঙের চুইং গাম। এই মজাদার চুইং গাম চিবিয়ে বড় বেলুন ফোলানোর প্রতিযোগিতা করেনি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দায়। ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে চুইং গাম সবারই প্রিয়। কিন্তু সিঙ্গাপুরে যারা থাকে তাদের কপাল খারাপ বলতেই পারেন আপনি। কারণ তাঁরা চাইলেই চুইং গামের স্বাদ নিতে পারে না। কারণ, সিঙ্গাপুরে চুইং গামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে! শুধু তারাই চুইং গাম খেতে পারবে যাদের দাঁতের ডাক্তার খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। তবে অবশ্যই দোকানে গেলে হাতে প্রেসক্রিপশন থাকতে হবে।
চাবানো শেষে মানুষ চুইং গাম ফেলে দেয়, অনেকে সেটা ফেলে নির্দিষ্ট ময়লা ফেলার জায়গায়। আবার অনেকেই এই আঠালো খাদ্যবস্তুটি ফেলে রাস্তাঘাটের যত্রতত্র। আর এর আঠার কারণে একটা সময় সেই জায়গাগুলোতে দাগ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, অনেক সময় রেল যোগাযোগও পড়ে যায় হুমকির মুখে। চলুন জেনে নিই সিঙ্গাপুরে চুইং গাম নিষিদ্ধ হওয়ার কাহিনীটি কী।
কীভাবে নিষিদ্ধ হলো?
১৯৮৩ সালের কথা, যখন লি কুয়ান ইউ প্রধানমন্ত্রী, তখন জাতীয় উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চুইং গাম নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। চুইং গামের কারণে দেশের বহুতল ভবনের রক্ষণাবেক্ষণে অনেক সমস্যা হচ্ছিল, মেইলবক্সগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, দরজার তালা এবং লিফটের বাটনেও সমস্যা তৈরি হচ্ছিল। এর কারণ হলো, মানুষ চুইং গাম চিবিয়ে যেখানে সেখানে তা ফেলে দিত। আর এগুলো পরিষ্কার করতে গিয়ে সাফাই করার যন্ত্রও নষ্ট হয়ে যেত।
শুধু কি রাস্তাঘাট আর মেইলবক্স? পাবলিক বাসের সিটেও চুইং গাম লেগে থাকত। কাপড়ে লেগে যাওয়ায় অনেকেই পড়তেন বিব্রতকর অবস্থায়। আর এসব চুইং গামের দাগ সহজে কাপড় থেকে উঠানো যায় না। যাহোক, মন্ত্রণালয় থেকে যখন এই বিরক্তিকর বস্তুটি উঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব এলো তখন প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান মনে করলেন এতটুকুর জন্য চুইং গাম একেবারে বন্ধ করে দেওয়াটা একটু বেশিই কঠিন সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। নেহাত চুইং গামের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে মন ঠিক সায় দেয়নি প্রধানমন্ত্রীর।
১৯৮৭ সালে সিঙ্গাপুরে সবচেয়ে বড় রেলওয়ে সিস্টেম (ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট) চালু হয়। শুনতে একটু বিস্ময়কর ঠেকলেও এ সময় চুইং গামের কারণে ট্রেন চলচলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। কে বা কারা স্বয়ংক্রিয় ট্রেনের দরজায় চুইং গাম লাগিয়ে রাখতো। ফলে ট্রেনের দরজা বন্ধ হতো না। দরজা পুরোপুরি বন্ধ না হলে ট্রেন চালু হয় না। দেখা যাচ্ছে সামান্য এক চুইং গামের কারণে সিঙ্গাপুরের ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম! তাই ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গো চক টং চুইং গাম বন্ধের মতো কঠোর সিদ্ধান্তটি নিয়ে নেন। অ্যালকোহল এবং তামাক জাতীয় পণ্যের মতো একই আইনে চুইং গাম বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়।
চুইং গামের বদলে কলা চাবান
সরকারিভাবে ঘোষণার পর সিঙ্গাপুরে চুইং গাম প্রস্তুত করা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে সিঙ্গাপুরে সে সময় নানা বিতর্ক ও দ্বন্দের সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ মালোয়েশিয়া থেকে চুইং গাম আনা শুরু করে। পাচারকারীরা তখন অবৈধভাবে চুইং গাম পাচার করা শুরু করে। কারণ দাঁতের কোনো কোনো চিকিৎসার জন্য কিছু নির্দিষ্ট চুইং গাম খেতে হয়। তাই সে সময় সরকার পরিস্থিতি সামলাতে চুইং গামের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে রাজি হয়।
সিঙ্গাপুরে ১৯৯৪ সালে এক মার্কিন কিশোর স্প্রে পেইন্টের কারণে দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়, এই ঘটনাটি বিশ্বের গণমাধ্যমে সেই সময় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ পায়। এ সময় সিঙ্গাপুরের আরো আইনই উঠে আসে গণমাধ্যমগুলোতে, যেমন সিঙ্গাপুরের পাবলিক টয়লেটে ফ্লাশ করা বাধ্যতামূলক বিষয়ক আইন। এ সময় এ ধরনের নানামুখী প্রতিবেদনের কারণে একটি বিষয় রটে যায় চুইং গাম খাওয়া বা আমদানি করাটাও দণ্ডনীয় অপরাধ সিঙ্গাপুরে। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম চুইং গাম নিষিদ্ধের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করতে থাকে।
চুইং গাম ও স্প্রে পেইন্ট নিষিদ্ধ করার বিষয়টিকে ইঙ্গিত করে সেই সময় বিবিসির এক প্রতিবেদক লিখেছিলেন, এই আইন মানুষের সৃজনশীলতা নষ্ট করবে। তখন প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ উত্তরটাও দিয়েছিলেন বাঁকা করে, তিনি বলেন, ‘যদি আপনি চুইং গাম না চিবানোর কারণে কোনো কিছু চিন্তা করতে না পারেন, তাহলে কলা চাবান।’
চুইং গাম নিয়ে মার্কিন কোম্পানির মাথাব্যথা
১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী গো চক টং দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য নিয়ে আলাপ শুরু করেন। এ সংক্রান্ত চুক্তিটি USS-FTA নামে পরিচিত। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলেও এই চুক্তি নিয়ে আলাপ আলোচনা চলতে থাকে সিঙ্গাপুরের সাথে। বুশের সঙ্গে তৎকালীন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। ২০০৩ সালে চুক্তি প্রায় পাকাপাকি হয়ে গেলেও ইরাক যুদ্ধ ও চুইং গাম— এ দুটি বিষয় অমীমাংসিতই থেকে যায়।
এরই মধ্যে শিকাগোভিত্তিক চুইং গাম কোম্পানি, নাম উইলিয়াম রিংলে, তারা চুইং গামের বিষয়টি আবার সামনে আনে। মার্কিন প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের সহায়তায় তারা USS-FTA চুক্তির একটি এজেন্ডা হিসেবে চুইং গামকে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়। কারণ সিঙ্গাপুরে চুইং গামের বাজার ধরা। এজেন্ডা হিসেবে চুক্তির ভেতর চুইং গাম চলে আসায় একটু বিপাকেই পড়ে সিঙ্গাপুর সরকার। এরপর সুগার ফ্রি চুইং গাম, যেগুলোতে দাঁতের এনামেলের জন্য উপকারী উপাদান ক্যালসিয়াম ল্যাকট্যাট আছে, সেসব চুইং গামের ব্যাপারে ছাড় দেয় সিঙ্গাপুর। অবশ্য চিকিৎসাপত্র ছাড়া এসব চুইং গাম বিক্রি করা যাবে না, এমন বিধিনিষেধের আওতা টেনে দেওয়া হয় এতে।
যাহোক, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত ওই চুক্তি হয় সিঙ্গাপুরের এবং উইলিয়াম রিংলেও অল্প সংখ্যায় হলেও চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য চুইং গাম বিক্রির অনুমোদন পায়।
চুইং গামের কারণে শাস্তি
সিঙ্গাপুরে সাধারণ চুইং গাম কেনা ও বেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর কেউ যদি চুইং গাম চিবিয়ে রাস্তায় ফেলে তাহলে তাকে ৫০০ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ৪০ হাজার টাকা) জরিমানা দেওয়ার বিধান রয়েছে।