চীনের নকল পণ্য থেকে সাবধান

ইদানীং আপনার কোনো বন্ধু বা আত্মীয় কি চীন ঘুরে এসেছেন? কারণ এখন তো হরহামেশাই পরিচিতরা চীন যাচ্ছে। ঘুরে এসে আপনাকে বা আপনার স্ত্রীকে নিশ্চয় কিছু না কিছু উপহার দিয়েছে। এর মধ্যে বেশি থাকে ইলেকট্রনিক গ্যাজেট আর ব্যাগ। গুচি বা প্রাদার ব্যাগ পেয়ে হয়তো আপনার স্ত্রী আহ্লাদেও আটখানা। একটু পরখ করে দেখুন তো এটা আসল গুচি বা প্রাদা কি না। নাকি নকল?
কিংবা কোনো পার্টিতে সদ্য চীন ফেরত কোনো নারী বন্ধু উপস্থিত তার সগোত্রীয়দের সগর্বে তাঁর ব্যাগ দেখানোর সময় আপনি আড়চোখে একবার দেখে করে নিতে পারেন সেটা আসল না নকল। কারণ চীন ব্যাগ নকলের জন্য বিখ্যাত। সম্প্রতি একটি জরিপের তথ্য হচ্ছে স্রেফ ব্যাগ নয় এই তালিকায় আছে ইলেকট্রনিক গ্যাজেট, নামি ব্র্যান্ডের ব্যাগ, জুতা, স্পোর্টস শুজ ও ক্লোদ আর প্রসাধনী। চীনের পাইকারি মার্কেটগুলোতে আপনি দেদার পাবেন এসব ফ্যান্সি প্রডাক্ট।
এখন লুকোচুরির কিছু নেই। বরং চীনকে আজ বিশ্বের ওয়ার্কশপ হিসেবে সবাই জানে। দি ইকোনমিস্টের এ বছরের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের যে কোনো অরিজিনাল ব্র্যান্ডের এয়ারকন্ডিশনের ৮০ ভাগই হয় চীনে। এ ছাড়া মোবাইল ফোন হয় ৭০ ভাগ আর জুতা ৬০ ভাগ। একই সঙ্গে একই পণ্যের বিপুল পরিমাণ নকলও হয়ে থাকে।
এই নকল নানাভাবে, নানা প্রক্রিয়ায় হয়ে থাকে। যেমন :
১. সরাসরি কোনো কারখানা থেকে একটি বা দুটি আসল পণ্য চোরাই পথে বাইরে বেরিয়ে সোজা চলে যায় নকল কারখানায়। সেখানে হয় পুনরুৎপাদন।
২. আবার স্থানীয় কোনো ফ্যাক্টরি কোনো ব্র্যান্ড প্রডাক্টের ছবি দেখে কিংবা আসল কোনো একটি পণ্য কিনে এনে সেটা থেকে নকল করা শুরু হয়।
৩. বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের প্রডাক্টকে কপিক্যাট করে নাম আর লোগোটা একটু অদলবদল করে নকল পণ্য তৈরি করে। এ ক্ষেত্রে উচ্চারণটা তারা কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করে।
এসব যে আমাদের দেশে হয় না তা নয়। তবে চীন এ ব্যাপারে ওস্তাদ। সেখানে কনজিউমার ইলেকট্রনিকস (ফোন, ট্যাব ইত্যাদি) হলো এই নকল জগতে সবচেয়ে জনপ্রিয়। একদম এক নম্বরেই এর অবস্থান। এখন আপনি আইফোনের একেবারে লেটেস্টটাও পেয়ে যাবেন। আসলটা কিনতে গেলে আপনার যা লাগত তার অর্ধেক বা তারও কমে আপনি পাবেন লেটেস্ট মডেলটি। এই ধরনের কার্যক্রম সে দেশে যাকে বলে বল্গাহীন। এ বছরই পুলিশ চীনের একটি কারখানা তল্লাশি চালিয়ে অন্তত ৪০ হাজার নকল আইফোন জব্দ করে। যার দাম ছিল অন্তত এক কোটি ৯০ লাখ ডলার।
এবার আসা যাক নকল ব্যাগ প্রসঙ্গে। লাক্সারি ব্র্যান্ড ব্যাগ বলার অপেক্ষা রাখে না, যে কোনো মেয়েরই স্বপ্ন। অথচ সবার পক্ষে তো আর কেনা সম্ভব হয় না। বাস্তবিকই সে সামর্থ্যই বা কজনের থাকে। ফলে তাদের নির্ভর করতে হয় নকল ব্র্যান্ড ব্যাগের ওপর। অনেকটা হয়তো সেই চাহিদা থেকেও এই প্রক্রিয়ার শুরু। এসব ব্যাগ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন ধারা যাক, হাই-এন্ড কপি। এসব ব্যাগ হুবহু আসলের মতো। দেখে ধরার জো নেই। একই লোগো। অবিকল ডিজাইন। অনবদ্য ওয়ার্কম্যানশিপ আর চমৎকার মেটেরিয়াল।
আবার এক ধরনের ব্যাগ আছে যেগুলোর লোগো ও ডিজাইন এক। তবে উপাদান নিম্নমানের। এ ছাড়া আছে কাউন্টারফিট। এসব ব্যাগের ডিজাইন এক হলেও লোগো ভুল বানানে বা বানান বদলে লেখা। মান একেবারেই যাচ্ছেতাই। গড়পড়তা পাইকারি বাজারে গেলেই সাধারণ বা নিম্নমানের এসব ব্যাগ পাওয়া যাবে। তবে কিছু বাজার আছে যেখানে মানসম্পন্ন নকল ব্যাগ বিক্রি হয়। এসব ব্যাগ দেখে ক্রেতার পক্ষে আসল-নকলের পার্থক্য করা প্রায় অসম্ভব। উহানের হোলসেল মার্কেট জরিপ বলছে, প্রাদা, শ্যানেল, বারবেরি বা লুই ভাটোর ব্যাগ কেনা সম্ভব মাত্র ৩৫ ডলারে; যা একেবারেই অবিশ্বাস্য। কেবল নকল ব্যাগই নয়, সঙ্গে নকল মানি রিসিপ্টও দেবে। এমনকি হ্যাংট্যাগের বারকোড এমনভাবে দেওয়া থাকবে, যা স্ক্যান করলে হংকংয়ের আসল ব্র্যান্ডশপের ঠিকানা চলে আসবে।
জুতো, স্পোর্টস শুজ আর ক্লোদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। সবচেয়ে বেশি নকল হয় নাইকি, অ্যাডিডাস, নিউ বালান্স আর কনভার্স। জুতা নকলের ট্রেন্ড শুরু হয়েছে আশির দশক থেকে। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো সস্তাশ্রমের লোভে চীনে এসে তাদের প্রোডাক্ট আউটসোর্স করা আরম্ভ করে। ফুজিয়ান, ঝেজিয়াং আর গুয়াংডং- এই তিন পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ সেই থেকে ক্রমেই হয়ে উঠেছে জুতা উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র। বছর দশেক সময় নেয় তারা বুঝে উঠতে। তারপর নব্বই দশক থেকেই মেতে ওঠে নকলের মহোৎসবে। বছর দুয়েক আগে সাড়ে পাঁচ কোটি ডলারের জুতা জব্দ করা হয়। অনলাইন স্টোর ইবে ২০১২ সালে জানায় যে তাদের ওয়েবসাইটে বিক্রীত ৯০ ভাগ নাইকির জুতাই নকল।
চীনের সবচেয়ে বড় অনলাইন স্টোর আলীবাবা ডট কমেও তো নিয়মিতভাবে নকল জিনিস বিক্রি হয়। এ জন্য গেল জুলাই মাসে তাদের কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগও জানায় আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন।
আর প্রসাধনের ক্ষেত্রে তথ্য হচ্ছে, চীনের বাজারে বিক্রীত কম করে ২০ শতাংশই নকল। অন্য প্রোডাক্টের মতো এসব প্রোডাক্টের প্যাকেজিংটা করা হয় অবিকল। যাতে বোঝা কঠিন হয়ে যায় ক্রেতার পক্ষে। গোলটা বাধে অন্য জায়গায়। এসব প্রসাধনীর উপাদান যথাযথ থাকে না। ফলে তা ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
বিগত ২০ বছর বা তার বেশি সময় ধরে চীন নকল সামগ্রী তৈরিতে দারুণ মুনশিয়ানা দেখিয়ে চলেছে। নকলশিল্পের বার্ষিক আয়ও মন্দ নয়। কর্মসংস্থান হচ্ছে। বিদেশি পর্যটকরাও এই নকলের খোঁজে ভিড় করেন চীনের নানা শহরে। অবশ্য ধরপাকড় যতই করা হোক এতে প্রশাসনের পরোক্ষ সায় যে আছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ জন্য চীনে গেলে যেটাই কিনতে আগ্রহী থাকেন না কেন, অন্তত প্রসাধন কেনা থেকে বিরত থাকাই ভালো।
লেখক : সাংবাদিক ও লাইফস্টাইল প্রফেশনাল