মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন কুসুম্বা শাহী মসজিদ

মুসলিম স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন নওগাঁর মান্দা উপজেলার ঐতিহাসিক কুসুম্বা শাহী মসজিদ। ঐতিহাসিক কুসুম্বা শাহী মসজিদটি নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে মান্দা উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়নের কুসুম্বা নামক একটি প্রাচীন গ্রামে অবস্থিত।
পাঁচ টাকার কাগজের নোটে মুদ্রিত রয়েছে মসজিদটি। স্থানীয়দের কাছে এটি কালপাহাড় নামেও পরিচিত। বর্তমানে কুসুম্বা শাহী মসজিদে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। মসজিদের পূর্বাংশে রয়েছে ৭৭ বিঘার একটি দিঘি। গ্রামবাসী ও মুসল্লিদের খাবার পানি, গোসল ও অজুর প্রয়োজন মেটানোর জন্য এ দিঘিটি খনন করা হয়েছিল। এর পাড়েই করা হয়েছে কুসুম্বা মসজিদ। আয়তাকার মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ১৭.৫৭ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১২.৭২ মিটার। মসজিদের দেয়ালসমূহ প্রায় ১.৮১ মি প্রশস্ত। ইটের তৈরি এ মসজিদের দেয়ালসমূহ বাইরে ও ভিতরে কালোপাথর দ্বারা আবৃত। এ মসজিদটিকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মসজিদের প্রবেশ পথের উপরে স্থাপিত শিলালিপি অনুযায়ী, ৯৬৬ হিজরী বা ১৫৫৮-১৫৫৯ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহের বংশধর আফগানি শাসনামলের সুর বংশের শেষ দিকে সুলতান গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহের আমলে জনৈক সোলায়মান কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয়েছে বলে জানা যায়।
১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মসজিদের তিনটি গম্বুজ নষ্ট হয়ে যায়। পরে সেগুলো প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর সংস্কার করে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদের ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনায় কুসুম্বা মসজিদটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করে এবং অর্থ মন্ত্রণালয় ১৯৭২ সালে পাঁচ টাকার নোটে কুসুম্বা মসজিদের ছবি মুদ্রিত করে।
ঐতিহাসিক কুসুম্বা শাহী মসজিদটি চতুষ্কোণ বিশিষ্ট কালো ও ধূসর বর্ণের পাথর এবং পোড়া মাটির ইট দ্বারা নির্মিত। মসজিদের ভিতরে দুইটি কালো পাথরের স্তম্ভ দ্বারা দুটি আইল ও তিনটি বে দ্বারা বিভক্ত। ছাদে দুই সারিতে তিনটি করে মোট ছয়টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটির বাইরের দেয়ালে এবং মিহরাবের উপরে কালো পাথরে খোদাই করা অলংকরণ রয়েছে। মসজিদের চার কোণে চারটি অলংকৃত অষ্টকোণাকৃতি বুরুজ বা কর্নার টারেট রয়েছে। পূর্ব দেয়ালে তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ এবং উত্তর ও দক্ষিণে দুইটি করে খিলানযুক্ত জানালা রয়েছে। পশ্চিম দেয়ালের অভ্যন্তর ভাগে আঙ্গুর গুচ্ছ ও ফুল- লতাপাতার অলংকরণ সমৃদ্ধ তিনটি মিহরাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি কালো পাথরের প্যানেল দ্বারা আবৃত এবং অত্যন্ত কারুকার্য খচিত ঝুলন্ত শিকল, ফুল ও লতাপাতার নকশা অলংকৃত রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরে উত্তর-পশ্চিম কোণে উত্তরের মিহরাবের সঙ্গে সমন্বয় করে নকশা করা চারটি কালো পাথরের পিলার দ্বারা খিলানাকৃতির দরজা এবং এর উপর তৈরি করা হয়েছিল একটি আয়াতাকৃতির মঞ্চ যা ‘বাদশাহ-কি-তাখ্ত’ বা ‘জেনানা গ্যালারি’ নামে পরিচিত। আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, এই স্থানে বসে কাজী (বিচারক) বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।
মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করতেই নজরে আসে বাক্স আকৃতির একটি কালো পাথরের। কথিত আছে, এক কৃষক হালচাষের সময় তার জমিতে এই পাথরটি দেখতে পান। পাথরটি লাঙলের ফলার আঘাতে কিছুটা ভেঙে যায়। পাথরটি জমি থেকে তুলে এনে রাস্তার পাশে রাখা হয়েছিল। উদ্ধারকৃত পাথরের গায়ে তোগড়া হরফে আরবি লিপি রয়েছে। ‘আল মালিকু মা হুমম মোকাররামা আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ বিন সৈয়দ আশরাফ আল হোসেন। অর্থাৎ তিনি শাসক যিনি পরাক্রমশালী ও সম্মানের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আল হোসেনের ছেলে আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ।’ এ থেকে বোঝা যায় পাথরটি হুসেন শাহের স্মৃতি বিজড়িত।
প্রাচীর বেষ্টিত এ মসজিদের সামনেই রয়েছে প্রায় ৭৭ বিঘা আয়তনের সুবিশাল এক দিঘী, যেটি এখন কুসুম্বা দিঘী নামে পরিচিত। কথিত আছে এ দীঘির তলদেশে পারদ মিশ্রিত থাকায় পানিতে কচুরিপানা বা অন্য কোনো আগাছা জন্মে না। দীঘিতে নামার জন্য দুটি দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি রয়েছে। যেখানকার শান বাঁধানো ঘাটে ওজু করেন মুসল্লিরা। দীঘির হৃদয় শীতল করা পানিতে দর্শনার্থীরা হাত-মুখ ধুয়ে ক্লান্তি দূর করেন। আবার অনেকে এই দীঘিতে নেমে গোসলও করেন।
মুসলিম স্থাপত্যের ঐতিহাসিক এ নিদর্শনটি দেখতে প্রতিনিয়ত ভিড় জমান দূরদূরান্ত থেকে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার এবং বছরের দুই ঈদে প্রচুর দর্শনার্থীদের সমাগম হয় কুসুম্বা শাহী মসজিদে। এ মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দোকানপাট।
ঐতিহাসিক কুসুম্বা শাহী মসজিদের পেশ ইমাম ওবায়দুল হক বলেন, ঐতিহাসিক এই মসজিদটি দেখতে বিদেশি পর্যটকসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমান নর-নারী আসেন। অনেকেই দেখার জন্য, কেউবা মানতের জন্য আসেন। তারা এই মসজিদে এসে দুই রাকাত নামাজ পড়ে বিভিন্ন মানত করে থাকেন। তবে রমজান মাসে তুলনামূলক কম দর্শনার্থী আসে। ঐতিহাসিক কুসুম্বা শাহী মসজিদের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রতিনিধি নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কাস্টোডিয়ান মুহাম্মদ ফজলুল করিম বলেন, কুসুম্বা মসজিদ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। যেখানে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ঘুরতে আসেন। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে ভিড় বেশি হয়ে থাকে। সম্প্রতি মসজিদের কিছু কিছু স্থানে নোনা আমাদের নজরে এসেছে। কর্তৃপক্ষকে ইতোমধ্যেই বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। বরাদ্দের সীমাবদ্ধতার কারণে এবার সেগুলো সংস্কার করা যায়নি। নতুন বরাদ্দ এলে সেটি সংস্কার করা হবে।