চার শ বছরের পুরোনো এক গম্বুজবিশিষ্ট ‘পাকা মসজিদ’

ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার গালুয়া ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামে এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি প্রাচীন মসজিদ অবস্থিত, যা স্থানীয়ভাবে ‘পাকা মসজিদ’ নামে পরিচিত। ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি ভান্ডারিয়া-রাজাপুর মহাসড়কের গালুয়া বাজার থেকে মাত্র এক কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত।
প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন এই মসজিদটি বহু বছর ধরে স্থানীয় মুসল্লিদের নামাজ আদায়ের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পাশাপাশি, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবেও পরিচিত। মসজিদটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও, স্থানীয়দের মতে, এটি শত বছরেরও পুরোনো। পাকা মসজিদ কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে থাকলেও সংরক্ষণের অভাবে এটি ধ্বংসের পথে। প্রায় চার শতাব্দী পুরোনো এই স্থাপনাটি ইতিহাসের এক সময়ে ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন ছিল, তবে বর্তমানে যথাযথ যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
‘পাকা মসজিদ’ নামটি এর স্থাপত্যশৈলীর বৈশিষ্ট্যের কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মসজিদটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট, যা প্রাচীন বাংলার সুলতানি ও মুঘল স্থাপত্যরীতির ছোঁয়া বহন করে। স্থানীয়দের মতে, মসজিদটি মোগল আমলে নির্মিত হয় এবং সেই সময়ের স্থাপত্যশৈলী এতে সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। মসজিদটির দেয়ালে খোদাই করা নকশা ও কারুকার্য এখনো অতীতের গৌরবময় সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দেয়ালগুলো পাকা ইট ও চুন-সুরকির মিশ্রণে তৈরি, যা যুগের পর যুগ টিকে থাকার ক্ষমতা রাখে। মসজিদের অভ্যন্তরে সুনিপুণ কারুকাজ ও ইসলামিক নকশা দেখা যায়, যা তৎকালীন স্থাপত্যশিল্পের উৎকর্ষতার পরিচায়ক। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় এর অনেক অংশ ভেঙে পড়েছে এবং গাছপালার আধিক্যে এর সৌন্দর্যও ম্লান হয়ে গেছে।

এই মসজিদটি শুধু একটি নামাজ আদায়ের স্থানই নয়, এটি স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এখানে আদায় করা হয়। বিশেষ করে রমজান মাসে ও ঈদের সময় এখানে মুসল্লিদের ভিড় লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া, মসজিদটি ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। সংরক্ষণের অভাবে এর কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, এটি এখনো দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, অতীতের সাক্ষী হয়ে।
লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে যে, মাহমুদ খান আকন (মামুজি) নামের এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি বাংলা ১১২২ সালে থেকে মসজিদটি দেখা শোনা করেন। এর নকশা ও নির্মাণশৈলী বাংলার প্রাচীন মসজিদগুলোর আদলে তৈরি, যা টালি ইট দিয়ে গঠিত।
স্থানীয়দের মতে, মসজিদের কাছে পাওয়া একটি পরিত্যক্ত শিলালিপি থেকে এর নির্মাণকাল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পূর্বে মসজিদটি প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হলে স্থানীয় এক সমাজহিতৈষীর উদ্যোগে কিছু সংস্কার করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটিকে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় এবং সরকারি অর্থায়নে কিছু সংস্কার করা হয়। তবে বর্তমানে মসজিদটির প্রাচীর ও গম্বুজে শ্যাওলা জমে, ইটের গাঁথুনি দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং কাঠামোতে নোনাধরা দাগ দেখা যাচ্ছে।
প্রতিদিন বহু পর্যটক ও ইতিহাসপ্রেমী এই মসজিদটি দেখতে আসেন, তবে অযত্ন ও অবহেলার কারণে এর সৌন্দর্য এবং স্থাপত্যশৈলী হারিয়ে যেতে বসেছে। মসজিদটি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে অচিরেই এটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। মসজিদটির যথাযথ সংরক্ষণ করা হলে এটি একটি ঐতিহাসিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
রাজাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাহুল চন্দ বলেন, মুঘল আমলে নির্মিত মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নিয়ে কাজ করা হবে।