গোপালগঞ্জে মহাবারুণীর স্নানোৎসবে পূণ্যার্থীর ঢল

দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহাবারুণীর স্নানোৎসব চলছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পুণ্যার্থীরা উৎসবমুখর পরিবেশে পৌনে দু’শ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ স্নানে অংশ নিয়েছেন।
উৎসবকে কেন্দ্র করে ওড়াকান্দিতে পাঁচ দিনব্যাপী মহাবারুণীর মেলাও আরম্ভ হয়েছে। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বুধবার (২৬ মার্চ) রাত ১১টা ১ মিনিটে স্নানোৎসব শুরু হয়ে শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) রাত ৯টা ২৬ মিনিট পর্যন্ত।
জানা গেছে, এ স্নানোৎসবে মেলায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী পুণ্যার্থীরাও অংশ নিয়েছেন। পূর্ণব্রহ্ম শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ২১৪তম আবির্ভাব তিথি উপলক্ষে বুধবার রাত ১১টা ১ মিনিটে গদীনশীল ঠাকুর ও মতুয়ামাতা শ্রী শ্রী সীমা ঠাকুর ও পদ্মনাভ ঠাকুর কামনা সাগরে স্নান করে স্নানোৎসবের শুভ সূচনা করেন। এরপর পাঁচ কুড়ির দল স্নানে অংশ নেয়। তার পর থেকে চলতে থাকে পুণ্যার্থীদের অবিরাম স্নানোৎসবের পালা।
এ বছর রেকর্ড পরিমাণ ভক্ত ও পুণ্যার্থীর সমাগম ঘটেছে শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে। সেনাবাহিনী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এ স্নানোৎসবকে নির্বিঘ্ন করতে গত ১৫ দিন ধরে কাজ করেছে। তারা সেখানে টহলের পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে।
হরিচাঁদ ঠাকুরের ষষ্ঠ পুরুষ ও স্নানোৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি সুব্রত ঠাকুর হিল্টু জানান, স্নানোৎসবে দেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত এলাকা, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, নেপাল, ভুটানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী পুণ্যার্থীরা এসেছেন। তাঁরা দলে দলে ঢাক, ঢোল, শঙ্খ, কাশি বাজিয়ে লাল নিশান উড়িয়ে হরিবোল হরিবোল ধ্বনিতে এলাকা প্রকম্পিত করে স্নানোৎসবে অংশগ্রহণ করছেন।
এ বছর ২০ লাখ পুণ্যার্থী বারুণীর মেলা ও স্নানোৎসবে অংশ নেন বলে ধারণা করেন সুব্রত ঠাকুর। এ উৎসবকে ঘিরে ভক্তদের থাকার জন্য করা হয় আবাসন ও প্রসাদের ব্যবস্থা। সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি মতুয়া মহাসংঘের আড়াই হাজারেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবক সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানান ঠাকুর পরিবারের এ সদস্য।
শ্রীধাম ওড়াকান্দি বারুণীর স্নান উদযাপন কমিটির সদস্য ও ঠাকুর পরিবারের সন্তান সম্পদ ঠাকুর বলেন, ‘হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি একটি মহা তীর্থস্থান। সরকার কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছে। সেনা সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সদস্যরা ১৫ দিন ধরে কাজ করছে। গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসন ও কাশিয়ানী উপজেলা প্রশাসনের দিক নির্দেশনায় স্নানোৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাই আমরা উৎসবের আমেজে স্নানোৎসব করতে পারছি। ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়েই এ উৎসব হচ্ছে।’
ওড়াকান্দির স্নানোৎসবে খুলনা থেকে আসা সজিব বিশ্বাস বলেন, ‘এটি বারুণীর উৎসবের বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় স্নানোৎসব ও মেলা। এখানে পুণ্য লাভের আশায় স্নান করেছি। ওড়াকান্দিতে স্নান করলে পাপ মোচন হয় বলে আমরা বিশ্বাস রয়েছে। এ বিশ্বাস আমরা দীর্ঘ পৌনে ২০০ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় লালন করে চলেছি।’
মাদারীপুর থেকে আসা কলেজ ছাত্র পলাশ বিশ্বাস বলেন, ‘আমি এবারই প্রথম ওড়াকান্দিতে এসেছি বন্ধুদের সঙ্গে। স্নান করলাম, পরিবারের সবার জন্য মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করেছি।’
শরীয়তপুর থেকে আসা পুণ্যার্থী পূর্ণিমা বিশ্বাস বলেন, ‘বিগত ৫ বছর ধরে পরিবার পরিজন নিয়ে ওড়াকান্দির বারুণীর স্নানে অংশ নিতে আসি। এখানে স্নান করলে মনোবাসনা পূর্ণসহ সব পাপ-কষ্ট দূর হয় বলে বিশ্বাস করি। বিশ্বাসের ফলও পেয়েছি।’
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘এ স্নানোৎসব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ঠাকুরবাড়ির ওড়াকান্দিতে সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ চৌকি ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।’
নিপীড়িত ও অবহেলিত মানুষের মুক্তির দূত হিসেবে খ্যাত আধ্যাত্মিক পুরুষ পূর্ণব্রহ্ম শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর বাংলা ১২১৮ সালে মহা বারুণীর দিনে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার সাফলীডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ফাল্গুন মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথীর ব্রহ্ম মুহূর্তে জন্ম নেওয়া হরিচাঁদ ঠাকুর ১২৮৪ বঙ্গাব্দে ৬৬ বছর বয়সে জন্মের একই দিনে তিথিতে তিরোধানে যান। বাবা যশোবন্ত ঠাকুরের পাঁচ ছেলের মধ্যে হরিচাঁদ ঠাকুর ছিলেন দ্বিতীয়। বাল্য নাম হরি হলেও ভক্তরা তাঁকে হরিচাঁদ নামে ডাকতেন। এই পরম পুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুরের আবির্ভাবে সাফলীডাঙ্গা গ্রাম হয়ে ওঠে ধন্য। এর পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী গ্রাম ওড়াকান্দি হরিচাঁদ ঠাকুরের অলৌকিকত্ব ও লীলার জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এটি জেলা সদর থেকে মাত্র ৩৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পৌনে ২০০ বছর আগে ঠাকুরের আবির্ভাব দিবস উদযাপন উপলক্ষে ওড়াকান্দিতে স্নানোৎসবের প্রচলন করা হয়। তারপর থেকে প্রতি বছর এ উৎসব চলছে।