বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে চায় নিপু

সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ। সিলেট জেলা স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক। খেলা শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাংলাদেশের গোল। জালে বল জড়িয়ে স্ট্রাইকার সারোয়ার জামান নিপু ছুটছে উত্তাল গ্যালারির দিকে। দুই হাত ছড়িয়ে পাখির মতো উড়ল নিপু।
পুরো চ্যাম্পিয়নশিপ জুড়ে উড়েছে নিপু। নয় নম্বর জার্সি পরে ঘুম হারাম করেছে ভারত ও আফগানিস্তানের রক্ষণভাগের ফুটবলারদের। এখানেই থেমে যেতে চায় না নিপু। বলল, ‘বাংলাদেশের ফুটবলকে এগিয়ে নিতে চাই।’
প্রথম ম্যাচে পাঁচ মিনিটেই শ্রীলঙ্কাকে ভড়কে দিয়ে থেমে যায়নি নিপু। ৮৭ মিনিটে আরেকটি গোল করে জয় নিশ্চিত করে মাঠ ছেড়েছে সে। নিপুর অসাধারণ নৈপুণ্যে চার গোলে শ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ।
এরপর কেবলই জয়ের গল্প। চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি পেয়েছে কিশোরগঞ্জের সারোয়ার জামান নিপু।
সময়টা বড্ড কঠিন
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার সরারচর গ্রামে নিপুদের বাড়ি। বাবা লিয়াকত আলী মারা গেছেন অনেক আগেই। নিপুরা তিন ভাই ও এক বোন। মা মিনা বেগম চার সন্তানকে আগলে রেখে জীবনের পরীক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছেন।
নিপু নিজেই বলল, ‘টাকার অভাবে বিকেএসপিতে ভর্তির জন্য চেষ্টাটুকুও করতে পারিনি। অনূর্ধ্ব-১৫ ক্যাম্পে বাছাইয়ের জন্য যেতে পারিনি। এমনকি টাকার জন্য বাফুফের একাডেমিতে আয়োজিত প্রশিক্ষণও বাদ দিতে হয়েছে। খেলার বুটসহ অনেক কিছুই কেনার পয়সা আমাদের ছিল না।’
সরারচর শিবনাথ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে নিপু। নিপু জানায়, কষ্ট থাকলেও পড়া আর খেলা দুটোই সে আগলে রেখেছে নিজের কাছে। বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়ে পর পর তিনবার সেরা হয়েছে নিপু।
কটিয়াদি উপজেলায় ভূঁইয়া ফুটবল একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেয় নিপু। সরারচর নিজ বাড়ি থেকে গত তিন বছর ধরে প্রতিদিন ৩৫ কিলোমিটার দূরে একাডেমিতে হাজির হতো নিপু। দুই বেলায় চার ঘণ্টা প্রশিক্ষণ শেষ করে বাড়ি ফিরতে হয়ে যেত রাত। এরই ফাঁকে চলে পড়াশোনাও।
ফুটবলের পাঠশালায়
নিজ গ্রাম সরারচরে খেলার তেমন সুযোগ ছিল না। তাই ফুটবলার হওয়ার গোপন স্বপ্নটা নিপুর মনেই মরে যেতে বসেছিল!
কয়েক বছর আগে নিপুর বড় বোনের বিয়ে হয় পাশের কটিয়াদি উপজেলার পুলেরঘাট গ্রামে। বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েই নিপু দেখে বন্ধ হয়ে যাওয়া কালিয়াচাপড়া চিনিকল মাঠে একদল কিশোরকে ফুটবলের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
কালিয়াচাপড়া চিনিকল মাঠে স্থানীয় কিশোরদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দেয় ভূঁইয়া ফুটবল একাডেমি নামে একটি সংগঠন। ২০১২ সালে এ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন স্থানীয় বাসিন্দা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ। ফুটবল অনুরাগী হারুন অর রশীদ বর্তমানে ঢাকায় কর্মরত।
এই একাডেমিতে কিশোর ফুটবলারা বিনা খরচে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়ে থাকে। হারুন অর রশীদ খেলোয়াড়দের বল, বুট, পোশাক, কোচের বেতন থেকে শুরু করে যাবতীয় ব্যয় সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও নিজেই বহন করেন। হারুন অর রশীদ জানান, বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে সাহায্য সহযোগিতা পান তিনি। তিনি আরো জানান, আট থেকে ১৮ বছর বয়সী মোট ১৩৫ জন খুদে ফুটবলার বর্তমানে এই একাডেমিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।
নিপুর প্রাতিষ্ঠানিক শুরুটা ভূঁইয়া একাডেমি দিয়েই। একাডেমির খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন কিশোরগঞ্জ জেলার এককালের কৃতী ফুটবলার ও সাবেক পৌর কাউন্সিলর সোলায়মান খান। নামমাত্র পারিশ্রমিকে তিনি একাডেমিতে কিশোরদের গড়ে তোলার পেছনে সময় দেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। জেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে একাডেমিতে সকাল ও বিকেল দুই বেলায় ছুটে যান সোলায়মান।
সোলায়মান জানান, গত তিন বছরে এ একাডেমি থেকে তিন শতাধিক কিশোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া কিশোরদের সাফল্যও কম নয়। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১২ দলে এ একাডেমি থেকে ২০১৪ সালে দুজন এবং ২০১৫ সালে একজন সুযোগ পেয়ে কৃতিত্ব দেখিয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলার বর্তমান অনূর্ধ্ব-১৫ দলের ২০ জনের মধ্যে ১৩ জনই এই একাডেমির খেলোয়াড়। চলতি বছর কিশোরগঞ্জ ডিএফএ আয়োজিত জেলা ফুটবল লিগে একাডেমির ৬০ জন খেলোয়াড় বিভিন্ন দলের পক্ষে অংশ নিয়েছে। শুধু তাই নয়, এই একাডেমির কিশোর খেলোয়াড়রা ২০১৪ সালে এক প্রদর্শনী খেলায় কিশোরগঞ্জ জেলা দলকে ১-০ গোলে হারিয়ে চমক দেখায়।
অবশেষে আলো
শুরুর অল্পদিনের প্রশিক্ষণেই ফুটবল দক্ষতা দিয়ে কোচ সোলায়মানের নজর কাড়ে নিপু। কোচ সোলায়মান নিপুর সুপ্ত প্রতিভাকে বের করে আনতে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যান। সোলায়মান জানান, অনুশীলনে কঠোর বেশ পরিশ্রম করত নিপু।
সোলায়মান জানান, একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা হারুন অর রশীদও নিপুকে নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেন। তাই তিনি অনূর্ধ্ব-১৯ দলের উন্মুক্ত বাছাইয়ে অংশ নেওয়ার জন্য নিপুকে ঢাকায় আনেন। সেখানেই কোচ সৈয়দ গোলাম জিলানীর নজরে আসে নিপু। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় তিনি নিপুকে অনূর্ধ্ব-১৬ দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনিই বর্তমানে এ দলের কোচ।
সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নের পাশাপাশি সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ায় নিপুর স্বপ্নের পরিধি বেড়ে গেছে বহুগুণ। এখন নিপুর স্বপ্ন জাতীয় ফুটবল দলে জায়গা করে নেওয়া। নিপু বলে, বাংলাদেশের ফুটবলকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে অবদান রাখতে চাই।’
নিপুকে নিয়ে ভীষণ আশাবাদী তাঁর কোচ সোলায়মান খান। তিনি বলেন, ‘নিপুর ভেতরে যে প্রতিভা আছে তার সঠিক পরিচর্যা করা গেলে সে বহুদূর যাবে।
একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা হারুন অর রশীদ বলেন, ‘শুধু নিপু নয়, এই একাডেমির অনেক খেলোয়াড়ই ভবিষ্যতে দেশের ফুটবলের মূলধারায় অবদান রাখবে।’
কিশোরগঞ্জ ফুটবল খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক কৃতী ফুটবলার শফিকুল ইসলাম সুরুজ বলেন, ‘নিপু এখন কিশোরগঞ্জবাসীর গর্ব। এই একাডেমির খেলোয়াড়রা একদিন দেশের ফুটবলের মুখ উজ্জ্বল করবে।’