রানার স্মৃতিতে ভাস্বর যে জয়
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/02/07/photo-1423288781.jpg)
দুঃসহ কষ্ট নিয়ে ২০০৭ বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। ১৭ মার্চ ভারতের মুখোমুখি হওয়ার ঠিক আগের দিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান দুই তরুণ ক্রিকেটার মানজারুল ইসলাম রানা ও সাজ্জাদুল হাসান সেতু। অকালপ্রয়াত দুই বন্ধুর স্মরণে কালো ব্যান্ড হাতে বেঁধে, বিমর্ষ-মলিন মুখে মাঠে নেমেছিলেন হাবিবুল-মাশরাফিরা। কিন্তু সেই শোক যে শক্তিতে পরিণত হবে, সেটা হয়তো কেউ ভাবতেই পারেননি। ভারতকে ৫ উইকেটে হারিয়ে বিশ্বকাপে দারুণ সূচনা করেছিল বাংলাদেশ। আর জরুরি অবস্থার আইনি বাধা ভেঙে রাজপথে উল্লাসে মেতে উঠেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা।
জাতীয় দলের সতীর্থ হিসেবে বাংলাদেশ দলের সবার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা ছিল রানার। তবে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল মাশরাফি বিন মুর্তজার সঙ্গে। মাশরাফিও যেন সেই ম্যাচে পেয়েছিলেন কোনো অদৃশ্য শক্তি। আগুনঝরা বোলিং করে ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সেরা পেসার। ৩৮ রানের বিনিময়ে ৪ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন ম্যাচসেরাও।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ ছিল ভীষণ শক্তিশালী। কিন্তু সেই ম্যাচে সৌরভ গাঙ্গুলী, বীরেন্দর শেবাগ, শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, যুবরাজ সিং, মহেন্দ্র সিং ধোনিদের নিয়েও ভারত অলআউট হয়ে যায় মাত্র ১৯১ রানে।
ম্যাচের তৃতীয় এবং নিজের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই দুর্দান্ত এক ইনসুইঙ্গারে শেবাগকে বোল্ড করেন মাশরাফি। তিন ওভার পর আবার আঘাত হানেন তিনি। এবার তাঁর শিকার রবিন উথাপ্পা। ভারতের সংগ্রহ তখন ২২ রান। সাত ওভারের প্রথম স্পেলে মাশরাফির বোলিং ফিগারটাও ছিল দেখার মতো : ৭-২-২০-২। নতুন বলে তাঁর সঙ্গী সৈয়দ রাসেল একটানা ১০ ওভার বল করেছিলেন। উইকেট না পেলেও প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের ভুগিয়ে মাত্র ৩১ রান দিয়েছিলেন এই বাঁহাতি পেসার।
মাশরাফি-রাসেলের পর শুরু হয় দুই বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিক ও আবদুর রাজ্জাকের ‘ঘূর্ণি-জাদু’। ১৫তম ওভারে রাজ্জাকের বলে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে পড়েন টেন্ডুলকার। ২৫তম ওভারে রফিক যখন দ্রাবিড়কে এলবিডব্লিউ করলেন, ৭২ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ‘টিম ইন্ডিয়া’ বেশ দুশ্চিন্তায়।
পঞ্চম উইকেটে ৮৩ রানের জুটি গড়ে দলকে বিপদ থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন সৌরভ (৬৬) ও যুবরাজ (৪৭)। কিন্তু যুবরাজ ৪৩তম ওভারে রাজ্জাকের শিকারে পরিণত হওয়ার পর তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে ভারত। পরবর্তী দুই ওভারে সৌরভ, ধোনি আর হরভজন সিংকে আউট করেন রফিক ও রাজ্জাক। শুরুর মতো ভারতের ইনিংসের শেষটাও হয়েছে মাশরাফির হাতে। অজিত আগারকার ও মুনাফ প্যাটেলকে আউট করে ভারতকে ১৯১ রানে গুটিয়ে দেন তিনি। তিনটি করে উইকেট নেন রফিক ও রাজ্জাক।
মাশরাফি-রফিক-রাজ্জাকের চমৎকার বোলিংয়ের পর ব্যাট হাতে জ্বলে ওঠেন তিন তরুণ—সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম ও তামিম ইকবাল। তিনজনই তখন জাতীয় দলে নবীন। তিনজনেরই আবার সেটাই জীবনের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ। তবে স্নায়ুর চাপকে একটুও পাত্তা না দিয়ে তামিম-সাকিব-মুশফিক ফিফটি করে দলকে এনে দেন অবিস্মরণীয় জয়।
তামিমের সৌজন্যে বাংলাদেশ পেয়ে যায় উড়ন্ত সূচনা। এই বাঁহাতি ওপেনারের ৫৩ বলে ৫১ রানের আক্রমণাত্মক ইনিংসে ছিল সাতটি চার ও দুটি ছক্কা। সাকিব আর মুশফিক সেদিন ধৈর্য আর আস্থার প্রতীকে পরিণত। ৭৯ রানে তৃতীয় উইকেট হারানোর পর ৮৪ রানের জুটি গড়ে দলকে জয়ের পথে নিয়ে নিয়ে যান দুজনে। ৮৬ বলে ৫৩ রান করে আউট হন সাকিব। তবে তিন নম্বরে নামা মুশফিক মাঠ ছেড়েছিলেন দলকে জিতিয়েই। ১০৭ বলে ৫৭ রান করে অপরাজিত ছিলেন এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান।
ম্যাচ শেষে জয়টা রানাকে উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। পোর্ট অব স্পেনের কুইন্স পার্ক ওভালে রানার ছবি নিয়ে ‘ভিক্টোরি ল্যাপ’ দিয়েছিলেন অধিনায়ক হাবিবুল বাশার ও তাঁর সতীর্থরা।
এই হারের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি ভারত। এর পর শ্রীলঙ্কার কাছেও হেরে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল তারা। আর ভারতকে হারানোর সৌরভ সঙ্গে নিয়ে সুপার এইটে ওঠা বাংলাদেশ আরেকটি চমক দিয়েছিল ক্রিকেট-বিশ্বকে, ৬৭ রানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে।