সাক্ষাৎকার
‘সবার ফোন আসে শুধু বাবার কলই আসে না’
বাবার স্বপ্ন ছিল গ্যালারিতে বসে আমার খেলা দেখবেন। অথচ আজ তিনদিন হয়ে গেল চ্যাম্পিয়ন হলাম, সবার ফোন আসল শুধু বাবার কলই আসল না—কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা ধরে আসছিল মাহফুজুর রহমান রাব্বির। দিন তিনেক আগেই যিনি বাংলাদেশ যুব দলকে এনে দিয়েছিলেন এশিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। তার নেতৃত্বে প্রথমবার পুরুষদের ক্রিকেটে এমন অর্জন ধরা দিয়েছে। দেশের অর্জনে যখন আনন্দের ঢল নেমেছে তখন রাব্বির হৃদয়ে বাজছে বাবা হারানোর বেদনা।
তবে, এই বেদনা বুকে নিয়েও রাব্বি পার করছেন, জীবনের সেরা সময়। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে ভক্তদের ভালোবাসা পেয়ে জীবনের সেরা তিনদিন পার করেছেন তিনি। এশিয়া কাপ জিতে গতকাল ঢাকায় পা রেখেছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। বিমানবন্দরে পা রাখা থেকে একাডেমিতে ফেরা—সবকিছুতেই চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটারদের জন্য ছিল বিশেষ আয়োজন। দেশে ফেরার পর নিজের স্মরণীয় দিনগুলোর অভিজ্ঞতার কথা এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন যুব দলের অধিনায়ক মাহফুজুর রহমান রাব্বি।
হঠাৎ করে অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়ে এশিয়া কাপ জেতা, এই জার্নিটা কেমন ছিল?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : এই জার্নিটা আসলে অসাধারণ ছিল। তবে এখানে চ্যালেঞ্জ বলতে তেমন কিছু ছিল না। বিষয়টাকে কঠিন করে নেইনি আমরা। স্রেফ একটা ক্রিকেট ম্যাচ হিসেবেই নিয়েছি। সেভাবেই এগিয়েছি। সাফল্য এসেছে।
এখন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কেমন অনুভব করছেন?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : এই অনুভূতিটা আসলে বলে বুঝানোর কথা না। খুবই ভালো লাগছে। এই জন্য আমি আমার টিম ম্যানেজম্যান্টকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমার সতীর্থদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তারা সবাই সাপোর্ট না করলে আমাদের লক্ষ্যে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাদের সাপোর্টে আমার কাজটা সহজ হয়ে গেছে।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার তিনদিন পার হয়ে গেল, এই তিনদিনের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাই?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : এখন পর্যন্ত জীবনের সেরা তিনদিন গেল। দলের পরিবেশ দারুণ। প্রতিটা খেলোয়াড় খুবই আত্মবিশ্বাসী আছে। এই আত্মবিশ্বাস সামনেও কাজে লাগাতে হবে। এশিয়া কাপের উদযাপন এবার শেষ। এখন আমাদের নজর বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপে গুরুত্ব দিচ্ছি।
এশিয়া কাপ জিতে গেছেন, সামনেই বিশ্বকাপ, কতটা আশাবাদী? দায়িত্ব বেড়ে গেল কি না?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : বিশ্বকাপ নিয়ে অতিরিক্ত প্রত্যাশা করতে চাই না। অতিরিক্ত এক্সাইটেডও হতে চাই না। এশিয়া কাপের মতো নরমাল ক্রিকেট খেলতে চাই। ম্যাচ বাই ম্যাচ আগাতে চাই। ভালো করার প্রত্যাশা থাকবে তবে, রেজাল্ট যা আসে সেটাই আমরা ওইটাই মেনে নিব।
প্রতিটা দলের জয়ের পেছনে কোনো না কোনো মোটিভেশন কাজ করে, আপনাদের দলের ক্ষেত্রে কোন বিষয়টা বেশি কাজে দিয়েছে?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : ভারত ম্যাচের আগের রাতে আমরা আকবর আলি ভাইয়ের সাথে কথা বলেছিলাম। ওইটা আমাদের খুব কাজে দিয়েছে। ওই সময়টায় আকবর ভাই আমাদের যে কথা বলেছিলেন তা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমাদের জন্য। তখন উনি যা বলেছিলেন, আমার কাছে মনে হয় ওই কথাগুলো আমার দলকে অনেক আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল।
আকবর আলির (যুব বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক) সঙ্গে ঠিক কী কথা হয়েছিল?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : আকবর ভাই সাহস দিয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘ভারতের বিপক্ষে স্রেফ অন্য ম্যাচগুলোর মতোই খেলো। উপভোগ করবা। ওদের সাথে অবশ্যই ওদের চোখে চোখ রেখে খেলবে। ডোমিনেট করে খেলবে। তাহলে দেখবে তোমাদের থেকে পজিটিভ রেজাল্ট আসবে।’
ফাইনালের আগে আর কোনো সিনিয়রদের সঙ্গে কথা হয়ে ছিল?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : ব্যক্তিগতভাবে কেউ ফোন করেননি। কারও সাথে আমাদের কথা হয়নি। তবে, টিম ম্যানেজম্যান্টের মাধ্যমে মুশফিক ভাই আমাদের শুভকামনা জানিয়েছেন। ফাইনালটায় ভালো করার বার্তা দিয়েছিলেন। ফাইনালের পরও কারও সাথে কথা হয়নি। তারা তো আসলে সিরিজ নিয়ে ব্যস্ত আছেন।
টিম ম্যানেজম্যান্টের ভূমিকা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? সব মিলিয়ে তাদের সাপোর্ট কেমন ছিল?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : আসলে টুর্নামেন্টের আগে থেকেই উনারা অনেক সাপোর্ট দিয়ে আসছিলেন। উনারা অনুশীলনেও বেশ মনোযোগী করে তুলেছেন। বিশেষ করে আমাদের মানসিক দিক নিয়ে উনারা অনেক কাজ করেছেন। যেটা পুরো টুর্নামেন্টে অনেক কাজে দিয়েছে আমাদের। তাই উনাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
আপনাদের এই দলে অনেক সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার আছে, আপনার চোখে কে হতে পারে আগামীর সুপারস্টার?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : আমার কাছে মনে হয়—আরিফুল বেস্ট। আমার দলের পেসাররাও দারুণ। তবে, আমার পক্ষে নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। আমার দলের ১৫ জন সবাই একেকজন স্টার।
বোর্ড থেকে কোনো বোনাসের প্রত্যাশা আছে কী?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : ওই রকম কোনো চাহিদা নেই। বোর্ড থেকে যা বলবে তাতেই আমরা খুশি। আমরা যদি বিশ্বকাপে ভালো কিছু করতে পারি তখনকার জন্য আবদার তুলে রাখলাম। এখন বোর্ড থেকে কিছু দিলে দেবে, নয়তো নিজেরা মুখ ফুটে কিছু চাইব না।
পরিবার, আত্নীয়-স্বজন ও বন্ধুদের থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : তারা সবাই অনেক ভালো ওয়েলকাম করেছেন। তবে, সবকিছুর মধ্যে একজনকে খুব মিস করেছি। তিনি হলেন আমার বাবা। তিনি ২০২০ সালে মারা গেছেন। মা খুব খুশি। তিনি অপেক্ষায় আছেন আমি কখন বাড়ি যাব! বন্ধুরাও খুব উত্তেজিত। কখন বাড়ি যাব, কখন বাড়ি যাব! কাল আশাকরি বাড়ি যাব।
বাবার কথা বললেন, বাবার স্বপ্ন ছিল কি যে ছেলে ক্রিকেটার হবে?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল ক্রিকেট নিয়ে। বাবাকে নিয়ে আজ অনেক আক্ষেপ। উনি চেয়েছিলেন গ্যালারিতে বসে আমার খেলা দেখবেন। আমার ক্রিকেট ম্যাচ দেখবেন। এই কথাগুলো খুব মনে পড়ছে। আজ সবার কল আসে কিন্তু বাবার ফোন থেকে একটা ফোনও আমার ফোনে আসেনি। বাবার ফোন আর আসবেও না কখনও। বাবাকে খুব মনে পড়ছে আজ। বাবা ২০২০ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
প্রথমবারের মতো এত মিডিয়া কাভারেজ, দর্শকদের ভালোবাসা পাচ্ছেন, এই বিষয়টা কেমন লাগছে?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : এই ব্যাপারগুলো খুব উপভোগ করছি। এত মিডিয়ার সাথে প্রথমবার কথা কথা বলছি। কোনো রকম প্রেশার লাগছে না বরং উপভোগ্য মনে হচ্ছে।
নিজের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কি ? জাতীয় দলে কাকে ফলো করেন?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : আমি সাকিব ভাইয়ের খুব বড় ভক্ত। আমি উনাকেই অনুসরণ করি। আর কাউকে সেভাবে অনুসরণ করি না। আর হ্যাঁ, অবশ্যই দেশের জন্য ভালো কিছু করার ইচ্ছা আছে। যদি সুযোগ পাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশকে কিছু এনে দিতে চেষ্টা করব। সাকিব ভাই একজনই। তার মতো আর কেউ আসবে কি না সেটা বলা যায় না। আমার মনে হয় না, উনার মতো আর কেউ আসবে না। আমি যদি ভবিষ্যতে উনার কাছাকাছিও যেতে পারি তাহলে নিজেকে অনেক কিছু মনে করব।
ভক্তদের নিয়ে কিছু বলার আছে?
মাহফুজুর রহমান রাব্বি : ভক্তদের অনেক অনেক ধন্যবাদ। তাদের জন্যই মূলত আমরা অনেক মোটিভেটেড হয়েছি। আমরা মিডিয়াতে দেখেছি, আমাদের ভক্তরা আমাদের অনেক সমর্থন দিয়েছেন। এ ছাড়া গ্যালারিতে অনেকে এসেছেন। এটা অনেক অপ্রত্যাশিত ছিল যে এত প্রবাসী ভাইরা আমাদের খেলা দেখতে আসবেন। তাদের অনেক ধন্যবাদ। তাদের ভালোবাসা পেয়ে আমরা মুগ্ধ।