বাংলার হামজা, হামজার বাংলাদেশ

একজন মানুষ কতটা হাসতে পারে? কতক্ষণ ধরে রাখতে পারে বিনয়? হামজা দেওয়ান চৌধুরীকে দেখলে কিঞ্চিৎ জবাব পাবেন। পুরোটা পাবেন না, কারণ হামজার সবে শুরু। হাসিমুখ আর বিনয়ের অবতার ধরে রেখে তাকে পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ। কঠিন পথে তার তেমন সহযাত্রী নেই। হামজা বোধহয় সেসবের তোয়াক্কা করেন না। বাংলাদেশে মোটামুটি ১০ দিনের সফরে তিনি এতখানি বুঝে যাওয়ার কথা, ঘোর অমানিশায় পাড়ি দিতে হবে এমন এক পথ, যে পথ এখনও তৈরিই হয়নি।
মানুষটি হামজা বলেই আমরা বিশ্বাস রাখি। তিনিও কি বিড়বিড় করে বলেছেন আনমনে—আমি সেই নক্ষত্র হব, দিয়ে যাব আলো। হবো সন্ধ্যার সেই উঠোন, যেখানে মাদুর পেতে বসবে গল্পের হাট। শীতলপাটি হয়ে আরাম দেবো বৃদ্ধ শরীরকে। হবো সকাল বেলার পাখি। কাঁচা-মিঠে রোদ্দুরে উড়ে যাবে ক্লান্তি।
না বললেও ক্ষতি নেই। আমরা তা ধরেই নিয়েছি। হামজা নামক বিদ্যুতের ঝলকানিতে সরু পথের দেখা বোধহয় পেয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল নামক দিশেহারা সত্তা। ফিরে পেয়েছে নিঃশ্বাস, যাতে এতদিন মিশে ছিল শুধুই দীর্ঘশ্বাস।

‘যদি আপনি মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, খেলাটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন এবং আপনার জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।’ বলেছিলেন জাভি অ্যালোনসো। মাঝমাঠের অন্যতম এই কিংবদন্তি জানেন, জায়গাটার গুরুত্ব। মাঝমাঠ মানেই সুই-সুতোর কারবার। নকশি কাঁথা যেভাবে বোনা হয় কারুকার্যে, ফুটবলে মধ্যমাঠও এমন।
নিচে থেকে ওপরে, ডান থেকে বামে, সোজা থেকে আড়াআড়ি—মাঠের বাকি ১০ জনকে নিয়ে মালা গাঁথেন মিডফিল্ডাররা। ফুটবল যারা বোঝেন, তারা জানেন জায়গাটা কত উত্তপ্ত। রোজ নামের পাশে গোল নেই। অ্যাসিস্ট নেই। তবু, তারাই মধ্যমণি। অসার খেলায় প্রাণ ফেরান তারা। হামজাও এসেছেন প্রাণ ফেরাতে। জড় বস্তুতে পরিণত হতে যাওয়া বাংলার ফুটবলকে জাগিয়ে তুলতে বড্ড প্রয়োজন ছিল হামজার মতো কাউকে।
কী করেছেন হামজা? সাদা চোখে খুব বড় কিছু তো করেননি। জাতীয় দলে প্রথমবার খেলতে এসেছেন, গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন, মাঠে নেমে পারফর্ম করেছেন। অ্যাথলেটদের রুটিন ওয়ার্ক। সেটি কীভাবে করেছেন, তা অনেক বড় ব্যাপার। চোখের দৃষ্টি মেলে ধরলে তবেই দেখা মিলবে সাধারণ কাজে নিদারণ দক্ষতায় অসাধারণত্ব নিয়ে আসেন হামজা।

বাংলাদেশের জার্সিতে হামজার অভিষেক হয়েছে ২৫ মার্চ, ভারতের বিপক্ষে। ম্যাচটি খেলতে গত ১৭ মার্চ দেশে আসেন হামজা। তিনি জানতেন এই ম্যাচ যতটা ভারত-বাংলাদেশের, ঠিক ততটাই তার। হয়তো একটু বেশিই। প্রত্যাশার পাহাড়সম চাপ, প্রায় পুরো এশিয়ার চোখ তার ওপর। ভক্ত, এলাকাবাসী, সাংবাদিক, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ব্রিটিশ হাইকমিশন, ক্রীড়া উপদেষ্টা, ফটোসেশন, দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলন, ভারতে যাওয়া, ম্যাচ, তারপর আবার গণমাধ্যম—পড়তে পড়তে নিশ্চয়ই হাঁপিয়ে উঠেছেন আপনি? হামজা হাঁপাননি। ১০ দিনে তার ঠোঁট থেকে হাসি সরেনি। বরং, ঝরেছে মুক্তো হয়ে।
ডুবতে বসা দেশের ফুটবলকে টেনে তুলতে এসেছেন। আশায় বুক বেধেছে ভক্তরা। বিমানবন্দর থেকে বের হওয়া হামজা তখনও ক্লান্ত। আগের দিন ম্যাচ খেলা, পরদিন লম্বা ভ্রমণ। তিনি প্রথমবার ক্যামেরার সামনে। বলে দিলেন, ভারতকে আমরা হারাব। তার এই এক বাক্যে ফুটবলে জোয়ার এসে যায়। ভারত ম্যাচের একদিন আগে হামজা আবারও বলেন, ভারতকে হারানোর কথা। সঙ্গে মূল্যবান কিছু বক্তব্য। হামজার মতে, তার আসলে কোনো কৃতিত্ব নেই। একা কিছু করতেও পারবেন না। ধীরে ধীরে সবাই মিলে এগিয়ে নিতে হবে দেশের ফুটবলকে।

প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মাঝের এই বিশাল দূরত্ব ঘোচাতে হবে সবাই মিলে। সবাই কারা? ফুটবলার, ফেডারেশন, ভক্ত, সাংবাদিক, বিশ্লেষক—প্রত্যেককে রাখতে হবে ভূমিকা। কিংবদন্তি পেলে বলেছিলেন যথার্থ— ‘জয়ের একমাত্র পথ হচ্ছে দল হিসেবে খেলা।’ প্রাসঙ্গিক মনে হবে কিংবদন্তি কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের কথাটাও— ‘যদি আপনি বিশ্বাস না করেন যে আপনি পারবেন, তাহলে আপনার কোনো সম্ভাবনাই নেই পারার।’ হামজার বলা বাক্যগুলো তাই ভীষণ সত্য। জিততে হলে বিশ্বাস রাখতে হবে, লড়তে হবে সবাই মিলে।
জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয়নি, কখনও করেননি ক্যাম্প। ভাষাটাই এখন রপ্ত করতে পারেননি দারুণভাবে। অথচ, হামজা সবার মন জয় করেছেন প্রথম দেখাতেই। খেলোয়াড়রা তাকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত। ভারত ম্যাচে দল একের পর এক ভুল করলেও মনোবল হারায়নি হামজার কারণেই। ঠিক এটিই চায় ফুটবলপ্রেমীরা। ভুল হোক, না পাওয়ার বেদনা আসুক। বাংলাদেশের ফুটবলে হারানোর বাকি নেই। গৌরব, জৌলুস, ইতিহাস সব গেছে। সামনে সেসব ফিরিয়ে আনার পালা।

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা একজন কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ফুটবলার এখন আমাদের। যাকে আটকাতে প্রতিপক্ষ ফিরিয়ে আনে অবসরে যাওয়া দলের সেরা ফুটবলারকে। এরচেয়ে বেশি আর কী লাগে উদ্যম ফিরে পেতে? এখন যা প্রয়োজন, তা আমাদের উদ্যম ধরে রাখা। যেমনটা হামজা বলছিলেন, সবাই মিলে এগিয়ে নিতে হবে দেশের ফুটবলকে।